শীতের ভাটি যেন শিল্পীর আঁকা ছবি

প্রতীকীছবি: প্রথম আলো

ডিসেম্বর চলে গেল। পানি কমতে কমতে বিলের তলায়। চারদিকে যেন সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো। খালি পায়ে হাঁটলে ঘাসেরা খোঁচা দেবে পায়ের নিচে। অথচ বর্ষায় এখানেই অথই পানি। নৌকা ছাড়া চলার কোনো গতি নেই। এখন যেদিকে চোখ যায় অবিরাম সবুজ ভূমি। মাঝেমধ্যে পরিত্যক্ত জায়গায় সারি সারি হিজল-করচ। বড় গাছ বলতে এগুলো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে শীত, বর্ষা কিংবা শরতে। মামাবাড়ি ভাটি অঞ্চলে হওয়ায় প্রকৃতির সৌন্দর্যের এই লীলা দেখতে খুব একটা অসুবিধা হয় না প্রতিবার।

শীত এলেই ভাটি সাজে নতুন রূপে। আয়োজন শুরু হয় মাছ ধরার মধ্য দিয়ে। উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে বাড়িতে বাড়িতে। আর কিছু থাকুক না থাকুক মাছ থাকবেই। প্রায় উঠানেই দেখা যাবে রোদে সুতায় গেঁথে মাছ ঝুলানো হয়েছে শুঁটকির জন্য। মাছিরা ভনভন করছে সেগুলোর ওপর। মানুষের সঙ্গে সাদা বকেরাও উৎসবে মাতে। এক ঠ্যাং তুলে শিকারি দৃষ্টিতে কম পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। কাছে যেতে চাইলে ফুড়ুৎ করে উড়াল দেবে।

সেখানে রাস্তার পাশে বসে থাকলেও বেশ আরামদায়ক ব্যাপার হলো কোথাও হন ও শব্দদূষণের বালাই নেই। ভিড়ভাট্টা নেই। যদিও এখন মোটরসাইকেলের চলাচল বেড়েছে। দুই চাকার যন্ত্রটির বেশ কদর আছে রাস্তায়। চল আছে ঘোড়ার গাড়িরও। মাল নিয়ে ধীরে ধীরে হেলেদুলে যায়–আসে। কখনো আবার খালি গাড়িতে মালিক অলস হয়ে বসে থাকেন, তাঁকে টেনে নিয়ে যায়। কোথাও যেন কোনো তাড়া নেই, ব্যস্ততা নেই। এখানে সব ব্যস্ততার ছুটি। হেঁটে চলা মানুষের সংখ্যা বেশি।

ধুলাবালুমুক্ত পরিষ্কার বাতাসে দূর থেকে দেখা যায় শর্ষের মাঠ। সূর্যের আলোয় হলুদ ফুলেরা একরকম স্নিগ্ধতা ছড়ায়। ঘ্রাণ ম ম করতে থাকে। মৌমাছিদের আনন্দ–উল্লাস চলে ফুলের ওপর। মাঝেমধ্যে মেহমানদের কাফেলার দেখা মেলে। পরিবারের কয়েকজন মিলে আসছে কিংবা যাচ্ছে। মেহমানের আগমনে সাক্ষী থাকে বাতাসও। এবাড়ি–ওবাড়ি থেকে ভেসে আসে মাংসের গন্ধ। বিশুদ্ধ বাতাসে দেশি হাঁস-মুরগির রান্নার ঝাঁজ অন্যরকম। ডিসেম্বরে স্কুল-কলেজ ছুটি থাকে। বেড়াতে যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। শিকড়ের টানে আত্মীয়ের বাড়িতে ছুটে যায় মানুষ।

রক্তিম সূর্য পশ্চিমের আকাশে লুকাতে শুরু করলে কুয়াশা জেঁকে ধরে। দূরের পাহাড়গুলো ঝাপসা হতে থাকে। রাখালেরা বিশাল গরু-ভেড়ার পাল নিয়ে বাড়ির দিকে আসতে শুরু করে। সেসব অপরূপ দৃশ্য, চোখের শান্তি। মনে হবে কোনো এক শিল্পীর নিখুঁত হাতে যত্নে আঁকা ছবি। শহরের বিষাক্ত জীবন রেখে মাঝেমধ্যে এমন নির্মল পরিবেশে ঘুরে এলে আপনার মন গেয়ে উঠতে পারে—‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণি সে যে আমার জন্মভূমি।’

নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ