টেবিলে বসে পড়ছি। মা এসে বলল, ‘শান্ত, বাবা, তুই আরেকবার বেরিয়ে দেখ না কোথাও খুঁজে পাস কি না।’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘স্যারের পড়া এখনো শেষ করতে পারিনি। একটু আগেও তো খুঁজে দেখলাম। সফি বোধ হয় কোথাও চলে গেছে। তুমি চিন্তা করো না। যেভাবে গেছে, সেভাবেই ফিরে আসবে, দেইখো।’
‘আমাকে না বলে কোথায় গেল বল তো? বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে।’
সফি আমাদের কেউ না। মা ওকে কোথা থেকে নিয়ে এসেছে, তা–ও জানি না। জিজ্ঞেস করলেই বলে, কোনো এক বান্ধবীর ছেলে। সফির বাবা-মা কেউ বেঁচে আছে কি না, তা–ও জানি না। ওর বয়স ১০-১১ বছর হবে। মা ওকে এত যত্ন করে যে আমি মাঝেমধ্যেই বিরক্ত হই। মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। এসব দেখে প্রায়ই আমি খাবার রেখে উঠে যাই। কিন্তু আমার রাগের কারণ বুঝতে দিই না।
দুজন একসঙ্গে পড়তে বসি। আমার এসএসসি পরীক্ষার মাত্র দুই মাস বাকি। এদিকে মা হাতে ধরে ধরে ওকে লেখাপড়া শেখায়। মনে হয়, আমার চাইতে সফির পড়ার ব্যাপারে মা বেশি সতর্ক। আমার অসহ্য লাগে। মাকে যদি বলি, ‘এই শব্দটার উচ্চারণটা একটু বলে দাও তো।’ মা কেমন যেন তাড়াহুড়ার মধ্যে পড়ে যায়। দ্রুত সফির লেখা শেষ করে তারপর জিজ্ঞেস করবে, ‘হ্যাঁ, বল কোনটা?’
এইটুকু সময় অপেক্ষা করতেও আমি রাজি না। আগে নিজের ছেলেকে পড়াবে। তারপর যাকে খুশি পড়াক! বাবাকেও কখনো সফির ব্যাপারে কালোমুখ করতে দেখিনি। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় যদি বাবাকে বলি কিছু একটা নিয়ে আসতে, বাবা বাড়ি ফিরবে দুটি নিয়ে। একটা আমার হাতে দিয়ে সফির হাতে দেবে অন্যটা। তারপর আমাদের দিকে হাসিমুখে তাকায়।
আরও অনেকগুলো কারণে সফিকে ভালো চোখে দেখি না। যদি বলি, ‘দুপুরে খেয়েছিস?’ জবাবে সে মিনমিন করে কী যেন বলে। আমি রাগের মাথায় ধমক দিই, ‘বিড়বিড় করে কী বলিস? মুখে রা বেরোয় না?’
কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে চোখের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। প্রায়ই খেয়াল করি, আমার প্রতিটি ধমকেই ওর গায়ে কাঁপুনি ওঠে। চোখ দুটি ছলছল করে। তবু এসব আমার মনে নাড়া দেয় না। কারণ, সে আমার মায়ের ভালোবাসায় ভাগ বসিয়েছে।
রাত আটটা বাজে তখন। বাবা বাসায় ফিরেছে। আমি পড়ার টেবিলে বসে আছি। বাবাকে কী একটা বলতে চাচ্ছিল মা। এমন সময় বাবা বলল, ‘কেন যে দেখতে গিয়েছিলাম! চোখে ভাসছে। এক গ্লাস পানি দাও তো।’
সেদিন বিকেলে মা কোথায় যেন গিয়েছিল। আমি হাতে একটা টেনিস বল নিয়ে চেয়ারে বসে আছি। বলটা মাঝেমধ্যে মেঝেতে ছুড়ছি আবার হাতে নিচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, সফি দরজার কাছে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, ‘কী চাস?’ কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে সেই পুরোনো অভ্যাসে মিনমিন করে বলল, ‘শান্ত ভাইয়া, মা কোথায় গেছে?’
ওর মুখে ‘মা’ কথাটা শুনে প্রায় চমকে উঠলাম। সে তাহলে আমার মাকে ‘মা’ বলতে শুরু করেছে? আমি সাধারণত অশ্রাব্য বাক্য ব্যবহার করি না। সেদিন কোনো কিছু না ভেবেই এত জঘন্য বকা দিলাম! তারপর বললাম, ‘তোর এত দরকার কিসের?’ এতটা অপমান সহ্য করতে পারল না সফি। চোখ পানিতে টলমল হয়ে উঠল। গাল বেয়ে টপ টপ ফোঁটা পড়ে গেল মেঝেতে। আমি বলটা ওর দিকে ঢিল দেওয়ার ভঙ্গিতে ফের ধমকে উঠলাম, ‘যা সামনে থেকে।’
সে নিঃশব্দে হেঁটে চলে গেল। আমি পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করলাম। কতটা ভালোবাসা পেলে অন্যের মাকে ‘মা’ বলে ডাকতে পারে, তা বোঝার আগ্রহ আমার কখনোই ছিল না।
কিন্তু সফিকে যতই ধমক দিই, গালমন্দ করি, এমনকি মারধর করলেও সে কোনো দিন মাথা উঁচু করার সাহস পায়নি। মায়ের কাছে কখনো নালিশ পর্যন্ত করেনি।
একদিনের কথা মনে পড়ে। রেগে গিয়ে সজোরে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিলাম। সহ্য করতে না পেরে মেঝেতে উল্টে পড়ল। দেয়ালে মাথা লেগে সামান্য ফেটে গিয়েছিল। তারপর মাথায় হাত দিয়ে বসে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। হাতের আঙুলের ফাঁকে রক্ত গড়িয়ে নামছে দেখে থতমত খেয়ে গেলাম। সেদিন কিছুটা অন্যায় বোধ হয়েছিল। সেই অন্যায় ঢাকতেই কিংবা মাকে ফাঁকি দিতেই হোক, সফিকে দ্রুত ট্যাপকলের কাছে নিয়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগলাম। কিন্তু ফাঁকি দেওয়া গেল না। মা দৌড়ে এল। অস্থির হয়ে প্রশ্ন করতে লাগল, ‘কী হয়েছে? কী হয়েছে?’
ভয়ে কথা বলতে পারছিলাম না। সফি কান্না চেপে অতিকষ্টে বলল, ‘পড়ে গেছি।’ মা আরও অস্থির হয়ে ওকে নিয়ে ছুটল ডাক্তারের কাছে। আমি কিছুটা বিস্মিত হয়ে ঘরেই বসে রইলাম।
এর পর থেকে সফিকে সামান্য কারণেও কিছু বলতাম না। কিছু ঘটলে চুপ থাকতে ইচ্ছা করত না। সেদিন বিকেলে ঘরে প্রবেশ করছি। হাতে একগাদা বই। সফি বাইরে বের হতে যাচ্ছিল। দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই ওর সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খেলাম। সব কটি বই মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল। রেগে গিয়ে ধমক দিয়ে বললাম, ‘দেখে বের হতে পারিস না? আমাদের বাড়িতে কী তোর? চোখের সামনে বারবার মরতে আসিস কেন তুই? দূরে যেতে পারিস না?’
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে রইল মাথা নিচু করে। আমি বইগুলো তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। তারপর থেকেই শুনছি, সফিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। মনে মনে খুশিই ছিলাম। ওর চলে যাওয়াটাই উচিত হয়েছে। আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে আনন্দিত ছিলাম। কিন্তু মায়ের নাজেহাল অবস্থা শুরু হয়ে গেল। পুরো এলাকা খুঁজে ফিরতে লাগল। সফি যেন নিজেরই সন্তান!
মা খুঁজে খুঁজে পুনরায় বাড়িতে এসে দেখে, সফি এসেছে কি না। আমাকে অনুনয় করে বলল, ‘একটু বেরিয়ে দেখ না কোথায় গেছে।’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও এদিক-ওদিক একটু দেখেই বাসায় ফিরে এলাম। সফি দিনের বেলাতেই ঘর থেকে বের হয় না। এখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমাকে একা ফিরতে দেখে মা প্রায় ভেঙে পড়েছে। তার চেহারা এত মলিন হতে আমি কমই দেখেছি। আমার দিকে একবার তাকিয়ে ছিল। দেখলাম, মায়ের চোখের কোণে এক বিন্দু জল জমে আছে।
রাত আটটা বাজে তখন। বাবা বাসায় ফিরেছে। আমি পড়ার টেবিলে বসে আছি। বাবাকে কী একটা বলতে চাচ্ছিল মা। এমন সময় বাবা বলল, ‘কেন যে দেখতে গিয়েছিলাম! চোখে ভাসছে। এক গ্লাস পানি দাও তো।’
মা পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে ঠিকই, অথচ বাবা ঘামছে। মা বলল, ‘কেন কী হয়েছে?’
বাবা পানি খাওয়া শেষ করে বলল, ‘স্টেশন দিয়ে আসার সময় দেখি, লোকজন জড়ো হয়ে কী যেন দেখছে। উঁকি দিয়ে দেখি, একটা বাচ্চার ছিন্নভিন্ন দেহ রক্তে মাখামাখি। কী অবস্থা! মারা গেছে।’
বাবার মুখে কথাগুলো শুনে আমার বুকটা ধক করে উঠল। মা প্রায় চিৎকার করে উঠল যেন। ‘কী বলছ এসব? বাচ্চাটার বয়স কত হবে? ছেলে না মেয়ে?’
মায়ের আচরণে কিছুটা বিচলিত হয়ে বাবা বলল, ‘এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন?’
‘সফি ঘরে নেই বিকেল থেকে। কোথায় গেছে, তা–ও কিছু বলে যায়নি।’
মায়ের আর্তচিৎকারে আমি পড়া থামিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বাবা অফিসের পোশাক না খুলেই দ্রুত বেরিয়ে গেল। মা ছুটল বাবার পিছু। আমি খাটের ওপর গিয়ে বসলাম। কিছু বুঝতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, স্টেশনে যে বাচ্চাটা মারা গেছে, সে নিশ্চয় সফিই হবে। ওকে দূরে যেতে বলেছিলাম। কারণ, আমি জানতাম, ওর দূরে যাওয়ার মতো জায়গা নেই। কিন্তু তাই বলে এতটা দূরে চলে যেতে পারে, তা কখনো ভাবিনি। নিজেকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছা করছে। সফির মৃত্যুর জন্য হয়তো আমিই দায়ী থাকব। মাথায় এলোমেলো চিন্তা জমিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মনে মনে বলছি, ‘ফিরে আয় সফি। তোকে আর বকা দেব না। আর কখনো গায়ে হাত তুলব না। ফিরে আয়, ভাই।’
গালে হাত দিয়ে দেখি, আমার গাল ভিজে গেছে। আমি কি ওর জন্য কাঁদছি? এতটা মন খারাপ এর আগে কখনোই হয়নি। সব কৃতকর্ম যেন চোখের সামনে ভাসছে। এভাবেই অনেকটা সময় কেটে গেছে। চোখে কিছুটা ঘুম এসে জড়ো হচ্ছিল। হঠাৎ কেঁচি গেট খোলার শব্দ পেলাম। উঠে দেখি, মা ঘরে ঢুকেছে সফিকে সঙ্গে নিয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখ, সফিকে নিয়ে এসেছি।’
মায়ের হাসি হাসি মুখটি কেমন আনন্দে ঝলমল করছে। কোথা থেকে নিয়ে এসেছে বা খুঁজে পেল কীভাবে, সেসব কিছুই জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হলো না। সফির দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। ও সেই একইভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। এতক্ষণ কোথায় ছিল, তা–ও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। সব অবহেলা, বিরক্তিবোধ ভুলে আমি স্নেহকণ্ঠে ডাকার চেষ্টা করলাম, ‘সফি, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভাইয়ার পাশে এসে বসবি না?’
ভয়ে, বিস্ময়ে কিছুটা ইতস্তত হয়ে ও নিঃশব্দে হেঁটে এল।
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা