ছিন্নমূল মানুষের জীবনের লড়াই ‘ভাঙন’

‘ভাঙন’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যছবি: সংগৃহীত

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর ভাঙনে প্রচুর মানুষ ছিন্নমূল হয়। এই মানুষেরা বেঁচে থাকার তাগিদে এসে ভিড় করে নগরে প্রান্তরে। হাটে বাজারে, উড়াল পুলের নিচে, রেলস্টেশনে এসে ওরা আশ্রয় নেয়। রেললাইনের ধারে, নগরের কাছাকাছি উন্মুক্ত খালি জায়গা দখল করে এভাবেই গড়ে ওঠে শিকড়চ্যুত এসব দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের বস্তি। তেমন কিছু মানুষের টুকরা টুকরা জীবনের গল্প একই সূত্রে গেঁথে ‘ভাঙন’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেন। জীবনের ভাঙা–গড়া, কচুরিপানার মতো ভাসতে ভাসতে বেঁচে থাকা মানুষের গল্পগুলোকে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন পরিচালক।

গল্পে নদীভাঙন দেখানো হয়নি। দেখানো হয়েছে নদী ভাঙনের পরবর্তী মানুষের জীবনের ভাঙন। মূল গল্পটা পরিচালকের নিজের। সংলাপ রচনা করেছেন তিনি এবং একটি চরিত্রেও অভিনয় করেছেন।

চলচ্চিত্রের নাম ‘ভাঙন’ হলেও পাথরকে কেটে বা ভেঙে একজন শিল্পী যেভাবে মূর্তি তৈরি করেন, জীবনের অসংখ্য ভাঙনের মধ্যেও পরিচালক গড়ে তোলার ফসল তুলে এনেছেন।

রেলগাড়িতে বাঁশি বাজিয়ে বাঁশি বিক্রি করেন মোহন গায়েন। জীবন পোড়া একজন মানুষ। জীবনের ভাঙা গড়ার খেলায় ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠে, ভাসতে ভাসতে স্টেশনে এসে ঠাঁই নেয়। তিন কূলে তার কেউ নেই। বাঁশি তার জিয়ন কাঠি। বুকের ভেতর থেকে সুর ওঠে, বাঁশিতে ফুঁ দিলে সেই সুর জাদুতে পরিণত হয় এবং সেই জাদু অন্যের মনপ্রাণ ভরিয়ে দেয়। মোহন গায়েনের চরিত্রে সুন্দর অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু। এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র তাঁকে বলা যায়, আবার সিনেমাতে নায়ক বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি, পরিচালক সেই ধারণাটিকে ভেঙে দিয়ে নতুন করে গড়েছেন। চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা বাঁশির সুরও হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

লড়াকু মানুষের নিজের জীবনের থেকে বড় শিক্ষক কেউ নেই। ছিন্নমূল মানুষেরা নিজের অতীতের জীবন থেকে শিক্ষা পেয়ে একদিকে যেমন অনেক বড় শিক্ষক হয়ে ওঠেন, তেমনি অনেকের আশ্রয়ও হয়ে উঠতে পারেন। এখানে মোহনের হাত ধরে নতুন করে বাঁচতে চেয়েছেন সদর উদ্দীন। মোহন তার কাঁধে বাঁশির ঝোলা তুলে দিয়েছেন। কিন্তু সদর ধূর্ত প্রকৃতির। খুব তাড়াতাড়ি যেকোনো প্রকারে ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। বাঁশির ঝোলা কাঁধে রাখতে চায় না। মোহন বলে, ‘বাঁশির ঝোলা বড় ভারি রে, পেছন থেইকা টাইনা ধরে।’ এখানেই ছিন্নমূল গরিবের মধ্যেও দুই প্রকৃতির মানুষের তফাৎ বোঝা যায়। সদর পুনরায় সাট্টা জুয়ার চক্করে মেতে ওঠে, পকেট মারে, হাসপাতালে প্রিয়জনের চিকিৎসা করতে আসা দুঃস্থ মানুষের অতি কষ্টে জোগাড় করা টাকাও ছিনিয়ে নিতে তার বাঁধে না।

নদীভাঙনের অন্য এক শিকার, উচ্চ বনেদি বংশের মানুষ ছমির ফকির। ছোট বউ লতাকে নিয়ে এখন সে স্টেশনে ভিক্ষা করে। লতার সঙ্গে ছমিরের বয়সের অনেক পার্থক্য। সদর লতার সেই অপূর্ণ জায়গাটাতে ঢুকে পড়ে, প্রেমের নামে প্রতারণা করে। লতার গর্ভে একসময় সদরের সন্তান চলে আসে। আর সদর ঝেড়ে ফেলে দূরে সরে যায়। ছমির লতার অবৈধ সন্তানকে মন থেকে মেনে নিতে পারে না, আবার লতাকে ফেলে দিতেও পারে না। ছমিরের বড় বউও নতুন সন্তানকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু তীব্র আত্মগ্লানিতে ভুগে নারী সত্তায় লাঞ্ছিত, অপমানিত লতা একদিন দূরে চলে যায়।

জীবনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে চলে আসা অন্য এক চরিত্র চুড়ি-ফিতে-লিপস্টিক বিক্রি করা জুলি। ছিন্নমূল মানুষের জীবনে প্রেম থাকে না। মোহনের জীবনেও তাই কোনো মনের মানুষের সন্ধান মেলেনি, নিঃসঙ্গ একাকী বয়স গড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই প্রথম জুলিকে দেখে, জুলির জীবনের ভাঙা–গড়ার গল্প শুনে মোহনের মনে আশা জাগে। জুলিও মোহনের বাঁশির সুরের প্রেমে পড়ে। দুজনের জীবনের ক্ষত অপূর্ণ স্থানের দূরত্ব হয়তো ঘুচে যেত একসময়, কিন্তু এখানেও এসে ঢুকে পড়ে সদরের লালসা চোখ। সদর চুরি–ছিনতাই করে আনা অর্থ দিয়ে জুলির সঙ্গে শাড়ির ব্যবসা শুরু করে। বংশীবাদকের হাত ধরলে জীবনে কখনো অনেক টাকা আসবে না, সদরের সঙ্গে থাকলে অর্থের অভাব ঘুচে যাবে। মোহনকে মন দিয়ে বসেও জুলি শেষপর্যন্ত সদরের কাছে নিজেকে সমর্পন করে। আর এই বস্তিতে বেশি দিন থাকলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাবে বুঝতে পেরে সদর জুলিকে নিয়ে একসময় চলে যায়।

বস্তির মেয়ে পেটের তাড়নায় দেহ ব্যবসা করে, বস্তির যুবক ভাত চুরি করে খায় চড়া নেশায় ডুবে থাকে, নেশার খোরাক জোগাতে নিজের সন্তানকে পর্যন্ত পাচার করে দেয়। এমন সব বাস্তবের চরিত্রগুলোকে তুলে আনেন পরিচালক। দোকানদার আব্বাস মিয়া মাঝেমধ্যে গায়েনের বাঁশি শুনতে আসে দেখে বোঝা যায়, ছোট ছোট মানুষের জীবনে অনেক অভাব অভিযোগ আর যন্ত্রণা। কোথাও একটা গিয়ে ওদের মধ্যেও মানবিক বোধ, শিল্পবোধ এসব হারিয়ে যায়নি। মোহন চরিত্রটিও অনেক ক্ষত, দুঃখ-অপূর্ণতার মধ্যেও বাঁশিতে জীবন ভাসিয়ে দিয়েছেন। এখানেই যেন স্বপ্ন আর স্বর্গের প্রশান্ত চরাচর নেমে আসে। জীবনে কাউকে না পাওয়ার দুঃখ তাঁকে দিয়ে বাঁশি বাজিয়ে নেবে, জীবনে কাউকে পেয়েও ধরে রাখতে না পারার দুঃখ তাঁকে দিয়ে বাঁশি বাজিয়ে নেবে। আর এসব দুঃখী মানুষের চরিত্রগুলোকে তুলে এনেও পরিচালক আমাদের হৃদয়ে বেদনা জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন। এভাবেও মানুষ সহনশীল হয়ে ওঠে।

জুলির চরিত্রে সুন্দর অভিনয় করেছেন মৌসুমী। অভিনয়ে আরও ছিলেন প্রাণ রায়, মির্জা আফরিন, খলিলুর রহমান কাদেরী, মির্জা আফ্রিদা, রাশেদা চৌধুরী, মিশু চৌধুরী, সঞ্জয় রাজ রেজাউল রাজুসহ অনেকে। সুরকার, সংগীত পরিচালক রিয়েল আশিক, ঝংকার খন্দকার। আবহ সুর দিয়েছেন অমিত চট্টোপাধ্যায়। চিত্রগ্রাহক সৈয়দ রাশিদুল হাসান এবং সম্পাদনা করেছেন মনিরুল ইসলাম।

চলচ্চিত্রের নাম ‘ভাঙন’ হলেও পাথরকে কেটে বা ভেঙে একজন শিল্পী যেভাবে মূর্তি তৈরি করেন, জীবনের অসংখ্য ভাঙনের মধ্যেও পরিচালক গড়ে তোলার ফসল তুলে এনেছেন।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত