সকালের প্রথম রোদের ঝলক কপাল স্পর্শ করতেই ঘুম ভেঙে গেল। কাঁচা সোনায় মোড়ানো কী মিষ্টি এই রোদ! অলসতায় ভর করে শুয়ে থাকা যায় না এমন রোদের ঝলকে। ভোরের হিম হিম ভাবটা মুহূর্তেই বিদায় নিল বাধ্য ছেলের মতো। জানালার পর্দা সরাতেই ফালি ফালি রোদ্দুর ঘরে ঢুকে গেল। হলুদ বরণ এই রোদের সোনালি বর্ণচ্ছায়া শখের গাছগুলোতে পড়তেই তারা যেন খিলখিল করে হেসে উঠল। দেরি না করে পানি দিলাম টবে। জল-রোদ্দুরের খেলা চলছে আমার ঘরে!
ঘুম থেকে উঠেই প্রকৃতি দেখা আমার পালিত অভ্যাস। নিয়মমতোই আকাশ দেখছি। মেঘমুক্ত স্বচ্ছ সাদা-নীলাভ আকাশ। কোথাও কোনো জড়তা নেই। সরল গ্রাম্য কিশোরীর মনের মতো যেন পুরোটা পড়া যায়। অথচ কয়েক দিন আগেও পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘ এখানে–ওখানে স্তূপ হয়ে থাকত। আচ্ছা, কেউ কি আকাশটাকে পরিষ্কার করে দিল? ভোরে উঠেই বাড়ির বউরা যেমন সারা উঠান ঝকঝকে পরিষ্কার করে, ঠিক তেমন পরিষ্কার।
এখন চলছে হেমন্তকাল। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ—এ দুই মাস হেমন্তকাল। রাজকুমারী শরৎ যেতে না যেতেই হেমন্তের পদধ্বনি জানান দেয় মাঠ ভরা সোনালি ধান। শরতের হাত ধরেই আসে হেমন্ত। একটু শান্ত ধরনের ঋতু। খুব বেশি আয়োজন করে সে আসে না বিধায় আমরা মিষ্টি এ ঋতুটার কথা টের পাই না। যেভাবে আয়োজন করে আসে অন্যান্য ঋতু, তেমন করে না এলেও হেমন্তের বিশেষত্ব ভোলে না গ্রামবাংলা। হেমন্ত মানেই কৃষক ভাইদের খুশি। তাঁদের মুখে হাসি ফোটাতেই যেন আগমন। সোনালি ফসলের সম্ভার নিয়ে আগমন হেমন্তের। সচেতনভাবেই নজর এড়িয়ে চলে এই ঋতু। শরৎ আর শীতের মধ্যবর্তী সময়ে এসে হঠাৎই যেন বিদায় নেয়।
এক কাপ চা হাতে নিয়ে ছাদে উঠে আসি হেমন্ত কুড়াতে। ছাদে লাগানো লাউগাছের লিকলিকে ডগায় এখনো শিশির জমে আছে। শুভ্র লাউ ফুলগুলো রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খিলখিল করে হাসছে। বিড়ালের কেশরের মতো কোমল রোদ। বেশ আরাম বোধ করছি। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলাম। কী অপূর্ব প্রতিটি ঋতু। প্রকৃতির কী উদার দান আমাদের! ভাবতে ভীষণ ভালো লাগছে। শিউলিগাছের নিচে অল্প কিছু শিউলি ফুল পড়ে আছে। সেগুলো হাতে নিয়ে গন্ধ নিতেই অবাক হলাম, অন্য একটা গন্ধ টের পেয়ে। শিউলির সুবাসের সঙ্গে এটা আবার কিসের গন্ধ যুক্ত হলো! পাশ ফিরে দেখি আমলকী আর চালতার আচার। সদ্য দেওয়া আচার কেউ শুকাতে দিয়েছে।
এই সময় চালতা, আমলকী, জলপাই আর কামরাঙার আচার দিত মা। সকালের মিষ্টি রোদে কতবার না সেই আচার চুরি করে খেয়েছি। হাত দিয়ে নিলে আচার নষ্ট হয় বলে মা কত বকত! লতা-পারুলগাছটায় ফুটন্ত ফুলগুলো রোদে চকচক করছে। ইচ্ছা করছে কিছু রোদ কুড়িয়ে বাক্সে জমাই। যদি ফের এমন সুন্দর রোদ না পাই!
মিষ্টি রোদ ক্রমেই উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে আর থাকা যাবে না। মন সায় দিচ্ছে না যেতে। ইচ্ছা করছে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে। প্রকৃতির সবটুকু সুখ উপভোগ করতে। গ্রামে গেলে কেমন হয়? আপন মনেই প্রশ্নের উত্তর দিলাম নিজেকে, গ্রামে যাব। কাল ভোরের ট্রেনে ছুটব কাঁচা মাটির উদ্দেশে। ইট-পাথরের এই শহরে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ করা নিছক বোকামি। বিশেষ করে হেমন্তের আমন ধানের ম–ম গন্ধ পেতে তো যেতেই হবে। যেখানে এখনো ইটের ছোঁয়া লেগেছে, পিচের ছোঁয়া লাগেনি। আজানেরও আগে ঘুম ভেঙে বিস্তীর্ণ মাঠে নামলে, খালি পায়ে চললে, হাতের কাছেই কুয়াশার দেয়াল দেখা যায়। দেখা যায় ঘাসের মাথায় বড় ফোঁটা। পা পিছলে যায়, অনেক সময় বোঝা যায় না, এটা শীত, না হেমন্ত। হেমন্তের এই নীরব উপস্থিতির সঙ্গ পরিপূর্ণভাবে পেতে হলে যেতে হবে গ্রামে। ভাবতেই কেমন উৎফুল্ল লাগছে নিজেকে।
ট্রেন ছুটে চলেছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। মাঠ–ঘাট, গাছপালা, দোকানপাট সবকিছু পেছনে ফেলে। শরতের কাশফুলেরা নুয়ে পড়তে শুরু করেছে। চলন্ত ট্রেনে হিম হিম হাওয়ায় হেমন্তের নদীর আহ্বান খুব টানছে। আচ্ছা, নদী টানছে, নাকি কবিতা? কিছুদূর যেতেই বিশাল এক শাপলা বিল। ফুটন্ত শাপলার হাসি মুখরিত করে তুলেছে দিগন্ত। হুটহাট ক্যামেরাবন্দী করে নিলাম দৃশ্যটি। কয়েকটি পাখি নদীর পানিতে ঝাঁপটে কিছু একটা ঠোঁটে নিয়ে উড়ে গেল। আকাশ এখন একদম নীল। কোনো এক গল্পের নীলিমা হতে ইচ্ছা করছে খুব।
‘আকাশের সব নীল পেড়ে শাড়ি বানাব;
কামিনী ফুলের মালা খোঁপায় গুঁজব;
দুচোখে কাজলস্বরূপ হেমন্তের নদী পরব;
ভোরের প্রথম রোদ কুড়িয়ে কপালে লাগাব টিপ!
প্রিয় চোখের প্রিয়া হব? হব কারও প্রিয় নীলিমা!’
ট্রেনের হুইসেলকে হঠাৎ মনে হলো যেন রোমান্টিক কোনো গানের সুর। ক্রমেই মনের আনন্দে ছড়িয়ে দিচ্ছে আয়োজন। প্রকৃতির সব আয়োজন আজ কেবলই আমার জন্য। পাড়ি দিয়েছি বেশ কয়েকটি স্টেশন। প্রতিটি স্টেশনই যেন জীবন। একেকটা অধ্যায়। প্রতিটি স্টেশন জীবনের গল্প বলে। চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকৃতি অনুভব এক অন্য রকম মজার। রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সোনালি ধান রাশি রাশি। স্নিগ্ধ রোদ খেলা করছে পাকা ধানের শীষে। চঞ্চলা কিশোরীর চুলের ঝুঁটির মতো ক্রমেই দোল খাচ্ছে মৃদু বাতাসে। ধানের সবুজ কচি ডগাগুলো হঠাৎই যেন হলদে রঙে ছেয়ে যায়। মাঠে মাঠে সোনালি রং উপচে পড়ে। ব্যস! কৃষক ভাইদের মন আনন্দে নেচে ওঠে। সন্তানের সফলতার মতোই উৎফুল্ল হয়ে ওঠে যত্নে লালিত জমি ভরা খুশি দেখে! কিশোরীর ঠোঁটের কোণের হাসি মেখে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি সুপারিগাছ।
ঘরে ঢুকতেই দেখি উৎসবের আমেজ। ফুফু এসেছে তার স্বামী-সন্তান নিয়ে, কাজিনরা এসেছে, বড় আম্মুর মেয়ের জামাই আসবে কয়েক দিনের মধ্যে। হেমন্ত মানেই মায়ের কোলে সন্তানের ফেরা। গ্রামে হেমন্তকাল মানেই নবীন সুর, নব উৎসব, নব উচ্ছ্বাস, নব আনন্দ! অনেক দিন পর যেন আপন অনুভূতি পাচ্ছি। রান্নাঘরের তাজা মাছের গন্ধ ম–ম করছে চারদিকে। উঠানের এক পাশে চাচি মস্ত এক হাঁসের মাংস কাটছেন। বড় আব্বু ভুঁড়ি নাচিয়ে মৃদু বুলিতে বলল, ‘কাঁচা মরিচ একটু বেশি দিয়ো; ওই ঝাল ঝাল খেতে ইচ্ছে করছে তো!’ বাড়ির সামনে কয়েকটি গাঁদা ফুলের গাছ। হলদে ফুলে চেয়ে গেছে। দুটো প্রজাপতি এ ফুল থেকে ও ফুলে ঘুরছে। মনে পড়ে কবি সুফিয়া কামালের কবিতার লাইন—
‘সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লিখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?’
পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বের হয়ে পড়ি কাজিনরাসহ। গ্রামে ভোরে আর সন্ধ্যায় হালকা ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। হিম হিম বাতাসে সোনালি প্রান্তরজুড়ে স্বর্গীয় অনুভূতি নেমে এসেছে। শিশিরভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে। নববধূর ঘোমটা টানা মুখের মতো লাগছে আবছা কুয়াশায় ঢাকা গ্রাম। খেজুরগাছ কাটা হয়েছে ইতিমধ্যে। আরেকটু শীত পড়তেই রস সংগ্রহ করবেন গাছিরা। দাদির লাগানো মল্লিকায় থোকা থোকা ফুল। মল্লিকা দাদির খুব পছন্দের গাছ ছিল। তার পাশেই গোলাকার বলের মতো একটি ফুল। দেখতে বেশ! নাম জিজ্ঞেস করতেই কেয়া জানাল, এটা হলো মণিকুন্তলা ফুল। মণির মতোই সুন্দর আসলে! হলুদ বরণ এই সকালটাকে যেন আরও রূপসী করে তুলেছে মণিকুন্তলা। বহু যুগের সৌন্দর্যের সন্ধিক্ষণের সাক্ষী হলাম।
ধানের বয়স্ক পাতায় বিন্দু বিন্দু জমা শিশিরকণা রোদের আলোয় মুক্তোর মতো লাগছে। নিশাদ একটা গঙ্গাফড়িং ধরে আমাকে দিল। যেন আমার শৈশবটুকু কুড়িয়ে দিল! নিশাদের চোখে হেমন্তের ভোরের আলো। শিশিরে গা এলিয়ে বসে আছে কয়েকটি ঘাসফড়িং। শিশিরস্নানে কি ঠান্ডা লাগবে না ওদের নিশাদ? আমার কথায় সে মুচকি হেসে হাঁটা ধরল। সবাইকে পেছনে রেখে আমি ছুটছি ধানের আইলে। সোনালি ধানেরখেত ডিঙিয়ে পূর্ব দিগন্ত রাঙিয়ে উঠছে ভোরের সূর্য। হালকা শীত শীত ভোরের ভেতর মিষ্টি রোদের ওম, ইশারায় শিস দিয়ে ডাকছে হেমন্ত- কার্তিক ও অগ্রহায়ণ। এ সৌন্দর্যের শেষ কোথায়?
ফিরে যাওয়ার সময় চলে এসেছে। নিজেকে নতুন করে প্রাণ দিলাম এই কদিন। নিশাদের চোখের হেমন্ত আজ কিছুটা নিভে গেছে। হঠাৎ যেন সবুজ প্রাচীরে ধস নেমেছে। বিকেলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। হেমন্তকালের বিকেলের সোনায় মোড়া রোদ আহ্বান করছে দূর দেশের অতিথি পাখিদের। দুপুরের তপ্ত রোদ এখন শীতল। হেমন্ত আসে মূলত শীতের আগমনী বার্তা জানাতে। শরতের বিদায়ের পর হেমন্তের উঠানে দাঁড়িয়ে শীতকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে রাস্তার পাশের ছাতিমগাছটা। ভরা যৌবন নিয়ে আসে হেমন্ত। উচ্ছ্বসিত হয় পুরো প্রকৃতি। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি শীতের রুক্ষতা এসে জড়িয়ে ধরে। অল্প সময়েই বার্ধক্য ভর করে নব যৌবনে। পাতাগুলোতে হলদে রং আসে। সময় হয়েছে তাদের শিশিরনিদ্রার।
ট্রেন ছাড়তেই মাগরিবের আজান দিচ্ছে। বিকেলগুলো ক্রমেই স্বল্প আয়ুর হয়ে যাচ্ছে। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে ওড়াউড়ি শুরু করেছে। দিনের প্রহরগুলো নীরবে দ্রুত পার হয়ে গেল। মৃদু হিম; কুয়াশাসিক্ত ভোর ও সন্ধ্যা কেমন ঘোর লাগার মতো সুন্দর। গোধূলির আভা হালকা কুয়াশার আবরণে ঢাকা পড়েছে। তবু মন্দ লাগছে না!
জীবনানন্দ বারবার ফিরতে চেয়েছেন এই বাংলায়। ওনার মতো ছন্দ জানলে আজ আমিও লিখতাম—
‘কার্তিকের ওই ধানের শীষে জেগে থাকা রোদে ফিরব কদিন পরেই আবার খেজুর পিঠার রসে!
শিশিরস্নাত রূপসা নদীর ঘাটে;
ফের খুঁজিব গঙ্গাফড়িং,
রোদ জড়াব শিউলি ফুলের বাটে!
তুমি-আমি পাল্লা দিয়ে ছুটব ফের, সোনা ধানের বাঁকে
কুয়াশা কুড়িয়ে দিও তবে, সুখ কুড়ানোর ফাঁকে।’
বন্ধু, কক্সবাজার বন্ধুসভা