আষাঢ় মাস, আকাশ এ সময় অভিমানী প্রেমিকার মতো মুখ গম্ভীর করে থাকার কথা। কিন্তু রুক্ষ গ্রীষ্মের মতো সূর্য সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দিচ্ছে। এই আষাঢ়ে ভিজে জ্বর বাঁধার সুযোগ ছিল। সারা দিন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে রাতে কাঁপতে কাঁপতে ঘুমানোর যে মজা, সেটা আর হচ্ছে না।
রৌদ্রের তীব্রতায় খালি পায়ে হাঁটাও মুশকিল। হিমুভক্ত হিসেবে খালি পায়ে হাঁটা যে আমার কর্তব্য।
আমার পরনে নতুন হলুদ পাঞ্জাবি। সেদিন ফেসবুক স্টোরিতে একটা হলুদ পাঞ্জাবির ছবি দিয়ে গিফট চেয়েছিলাম, সন্ধ্যায় দেখি একজন ডেলিভারি বয় মেসে এসে পাঞ্জাবিটা দিয়ে গেল। কে অর্ডার করছে জানতে চাওয়ায় বলল, বলতে নিষেধ করেছে। অপরিচিতদের থেকে কিছু নেওয়া অনুচিত। প্রিয় রঙের পাঞ্জাবি বলে লোভ সামলাতে পারিনি।
পায়ে জুতা নেই, সুলতানা সরোবরের উদ্দেশে হাঁটছি, কাঁধে একটা ব্যাগ থাকলে ভালো হতো। এখন দুপুর ১২টা, রোদের তীব্র আলোকরশ্মি আমার গায়ে লাগছে, কপাল থেকে ঘাম ঝরছে, তবু হাঁটছি।
সুলতানা সরোবরে গিয়ে দেখি কাকপক্ষীও নেই, নিস্তব্ধতা। একটা বেঞ্চে এক সুন্দরীর কোলে মাথা রেখে তার প্রেমিক আকাশ দেখছে। আমায় দেখে মেয়েটি প্রেমিককে তুলে দিল। এ সময়ে আসা আমার ঠিক হয়নি। নিজে কখনো প্রেম করতে পারিনি, তাই অন্যের রোমাঞ্চকর মুহূর্ত নষ্ট করার অধিকার নেই। মাথা নিচু করে পাশ কেটে চলে গেলাম।
এই বয়সেও আমার প্রেম হয়নি, এটা অনেকে মানতে নারাজ। একটা প্রেম করা দরকার। রুপার মতো মেয়ে হলে বেশি সুবিধা। তখন হয়তো তাদের মতো কোলে মাথা না রাখলেও পাশাপাশি বসে তাপমাত্রা নিয়ে গবেষণা করা যেত। সকাল থেকে কিছু খাইনি। কলেজ মোড়ে সস পুরির দোকানে যাওয়া দরকার।
দোকানে সিট নেই, ভর দুপুরে উপচে পড়া ভিড়। সামনের বেঞ্জে বসা এক সুন্দরী তরুণী আমার দিকে বিস্ময় চোখে তাকিয়ে। মনে মনে বললাম, এভাবে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠলে তো আমার ক্ষুধার যন্ত্রণা কমাতে পারি। মেয়েটি না শুনলেও মনে হলো এক ভদ্রলোক শুনেছেন, সিট পেলাম।
হঠাৎ মেঘের ডাকে চমকে উঠলাম, বৃষ্টি নামবে। খাওয়া শেষ করে বেরুতেই অঝোরে বৃষ্টি নামল, তাড়াতাড়ি বিল দিয়ে ভেজার জন্য রাস্তায় নামলাম, মেয়েটি এখনো তাকিয়ে আছে।
রাস্তায় দুই-একটা রিকশা চলছে। প্রশান্তি পাচ্ছি, জ্বর যদি বাঁধাতে পারি! এক দুপুর রোদ আর বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবেই। এমন সময় পেছন থেকে একটা রিকশা এসে আমার পথ রুদ্ধ করল। ছাতা নিয়ে বেরিয়ে এল পুরির দোকানে বসে থাকা মেয়েটি। তখন লোক সমাগম ছিল বলে সৌন্দর্যের দিকে নজর দিতে পারিনি।
এখানে স্যার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থাকলে অসাধারণভাবে তাঁর রূপের বর্ণনা দিতে পারতেন। মেয়েটি এখন যেন নিষ্পাপ তরুণী, কাজল পরিধিত চোখ থেকে নজর সরানো মুশকিল। ঠোঁট যেন গোলাপের পাপড়ি।
- বৃষ্টিতে ভিজে কোথায় যাচ্ছেন? আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই।
- আমাকে বলছেন?
- আশপাশে আর কাউকে তো দেখছি না।
- আপনাকে যে আমি চিনি না!
- আমি আপনাকে চিনি, আপনি মুহি না?
- জি, কীভাবে চেনেন?
- পরে বলব। আগে রিকশায় ওঠেন।
আমি হকচকিয়ে গেলাম। মেয়েদের সঙ্গে কখনো রিকশায় উঠিনি। তাও আবার অপরিচিত।
- কী হলো, দাঁড়িয়ে যে?
- আমি বৃষ্টিতে ভিজতে চাচ্ছি, আপনি যান।
- জ্বর আসবে!
- জ্বর আসার জন্যই ভিজছি।
- মানে কী?
- তীব্র জ্বরের স্বাদ কখনো নিয়েছেন? অসাধারণ ভালো লাগা কাজ করে।
- পাগলামি অনেক করেছেন, এখন রিকশায় আসেন।
- নাহ, আর একটু ভিজব। এই বলে হাঁটা শুরু করলাম,
পেছন থেকে ছাতা মাথার উপরে ধরে বলছে, ‘হিমু কাল্পনিক চরিত্র ছিল, আপনি যেটা করছেন এটা স্বাভাবিক মানুষ করতে পারে নাহ।’ আমি একটু লজ্জিত হয়ে হাঁটছি।
- আমাকে কীভাবে চেনেন?
- ফেসবুক থেকে, আপনার কবিতা ভালো লাগে, আরাবি ছাত্রাবাসে থাকেন, তাই না?
- এত কিছু কীভাবে জানেন?
- সব বিষয় বলতে নেই। অনেক ভিজেছেন, এখন মেসে গিয়ে গোসল দিয়ে এই ওষুধগুলো খেয়ে ঘুমান।
- ওষুধ খেলে তো জ্বর আসবে না।
- জ্বর আসতেও হবে না।
মানুষ কেন প্রেমে পড়ে বুঝতে পারলাম! এত যত্ন আগে কখনো পাইনি। আমার ওপর অধিকার খাটাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমি তার অনেক আপন। হার্টবিট বাড়ছে।
- পাঞ্জাবিতে আপনাকে ভালোই লাগছে।
- আপনি পাঠিয়েছেন?
- অপরাধ তো করিনি।
- তা করেননি, তবে কেন দিয়েছেন?
- গিফট চাইছেন তাই।
- বাকিরা তো দেয়নি।
- সবাই তো আপনার ভক্ত না।
কাঁচুমাচু করে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার পরিচয়টাই জানা হলো না!
- আপনার একজন ভক্ত মনে করতে পারেন।
- এটা তো পরিচয় হতে পারে না।
- তাহলে আপনি হিমু–ভক্ত হিসেবে পরিচয় দেন কেন?
বেশ মুশকিলে পড়লাম। আপনি আমার নাম, মেসের ঠিকানাও জানেন। আপনার নাম আর ঠিকানা বলেন।
- আমি পারু।
আমি থ হয়ে গেলাম। হিমুর উল্টো মুহি, পারু রুপার উল্টো। তাহলে আজ কি আমিও আমার প্রনয়ণীকে পেয়ে গেলাম। বেঞ্চে বসে আড্ডা দেওয়ার মানুষ আমারও হইল।
মেসের বড় ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। আশপাশে পারুকে খুঁজছি, কিন্তু বড় ভাইকে সামনে দেখে ঘোর কাটল। মুচকি হেসে বাইরে গিয়ে দেখি সত্যিই বৃষ্টি পড়ছে। তবে সন্ধ্যা হয়েছে। মেসের সবাই রান্না নিয়ে কথা বলছে। সন্ধ্যা না হলে হয়তো পারুকে খুঁজতে যাওয়া যেত। সিদ্ধান্ত নিলাম পারুর জন্য হলেও একদিন হিমুবেশে সুলতানা সরোবরে যেতে হবে।
বন্ধু, কুড়িগ্রাম বন্ধুসভা