‘দুই পয়সার আলতা’–এর মূল্য বাঙালি জীবনে চিরকালের

১৯৬৯ সালে কাজী জহিরের মধু মিলন ছবি দিয়ে রাজ্জাক-শাবানা জুটির শুরু। ১৯৭২ সালে নির্মিত এ জুটির অবুঝ মন ছবিটি দারুণ দর্শকপ্রিয়তা পায়। অবুঝ মন, সাধু শয়তান, মাটির ঘর, দুই পয়সার আলতা, চাঁপা ডাঙ্গার বউ, সখী তুমি কার, অমর প্রেম, রজনীগন্ধা এ জুটির উল্লেখযোগ্য ছবি

‘দুই পয়সার আলতা’ নামটির মধ্যেই একধরনের অসীম ব্যঞ্জনা লুকিয়ে আছে। আলতাটা দুই পয়সায় বা অতি সামান্য টাকাতে কেনা যায়, কিন্তু বাঙালি জনজীবনে এই আলতার মূল্য অর্থ দিয়ে মাপা যায় না। আবার আমাদের আজকের চলমান ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে অনেকের কথার দুই পয়সার মূল্য থাকে না। এক পয়সা, দুই পয়সার মুদ্রাগুলোও অচল হয়ে গিয়েছে বহুদিন হলো। কিন্তু মানুষের কাছে মানুষের কথার মূল্য, কথার দাম অচল হয়ে গেলে, অচল হয়ে পড়লে, সমাজে বিশ্বাসের জায়গায় ফাটল ধরে। একইভাবে যে মানুষের জীবন অনন্ত শক্তির আধার, রাষ্ট্রের কাছে, সমাজব্যবস্থার কাছে মানুষের জীবনেরও দুই পয়সার মূল্য থাকে না।

আবার ‘দুই পয়সার আলতা’ নামটা শুনলেই যাত্রাপালা যাত্রাপালা মনে হয়। আর এই যাত্রাপালাও গ্রামবাংলার জনজীবনের একটা দীর্ঘ যাত্রাপথের লড়াই সংগ্রামের ছবি। ঐতিহ্য সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবিও। ১৯৮২ সালে যখন আমজাদ হোসেনের ‘দুই পয়সার আলতা’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল, তখন মানুষের জীবনে বিনোদনের অন্যতম বড় মাধ্যম ছিল যাত্রাপালা। আমার জন্ম ১৯৮০ সালে। আমাদের চট্টগ্রামে রাউজান উত্তরগুজরা গ্রামে আমার বাবা ঠাকুমার নিজে হাতে গড়া কালীমন্দির এখনো আছে। বছরে একবার বড় করে কালীপূজা হয়। আমার বাবা তখন দুই-তিন রাতে যাত্রাপালার আয়োজন করত।

গ্রামের বাড়িতে তখনো বিদ্যুতের লাইন আসেনি। অনেকগুলো হ্যাজাক বাতি ভাড়া করে আনা হতো। সেই হ্যাজাক জ্বালানো আলোতে ছোটবেলায় রাতভর সামাজিক যাত্রাপালা দেখার অভিজ্ঞতা আছে। বাড়ির এমাথা–ওমাথা মস্ত ফুটবল খেলার মাঠের মতো উঠানে কয়েক হাজার মানুষের ভিড় দেখতাম। হিন্দু–মুসলিম–বৌদ্ধ—সব ধর্মের মানুষ পাশাপাশি বসে এই যাত্রার আসর উপভোগ করত। যাত্রা দলের শিল্পীদের মধ্যেও সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থাকত।

তেমন একটা সামাজিক অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে একটি চলচ্চিত্রের নামের মধ্যেও যাত্রার অনুরণন তৈরি করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন মানুষটিও ছিলেন একেবারে গ্রামবাংলার মাটির সুরের মানুষ। একসময় জহির রায়হানের সঙ্গে সহপরিচালক হিসেবে কাজ করতেন। জহিরের কালজয়ী ছবিগুলোতে মাটির মানুষের সুর, সংলাপ, জীবনের গল্পের অনেক উপকরণ সংগ্রহের কাজও করে গিয়েছেন তিনি। সেই মাটির সন্তান যখন নিজের কাজে হাত দেবেন, মাটির গন্ধ তো থাকবেই।

বৃদ্ধ ভিক্ষুককে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি অভিনয় করছেন। অবাক চোখে ভিক্ষুককে খেতে দেখা, ছোট্ট কুসুমের মুখে সহানুভূতির সংলাপ ‘আমার মা নাই, তোমারও মা নাই, খাও’ হৃদয় বিগলিত করে দেয়। আমজাদ ছিলেন সংলাপ তৈরির শ্রেষ্ঠ কারিগর। অনেক সময় সিনেমার শুটিং চলাকালে সামান্য অবসরেও তিনি মাজাঘষা করে দৃশ্য অনুযায়ী চরিত্রের মুখের সংলাপ তৈরি করতেন এবং চরিত্রের মুখে সহজ করে তা ধরিয়ে দিতেন।

এই চলচ্চিত্রে একটি দৃশ্য আছে, গ্রামের অবলা কন্যা কুসুমকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। এর আগেও দেখতে এসেছে, বাপ-মা মরা কন্যার চাচা-চাচি বিবাহে পণের কথা শুনে আমতা আমতা করে। সেই কুসুম এবার নিজেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুখে কালি মেখে এমন সাজ সাজল, পাত্রপক্ষ ভূত দেখার মতো আন্নাকালী কুসুমকে দেখে, ছুটে পালাতে শুরু করে। সেই দৃশ্যে আবহে তখন যাত্রাপালার চির পরিচিত সুর বেজে উঠেছিল।

বাঙালি ঘরের ছেলেমেয়েরা খেতে বসে ভাতের মধ্যে জীবনে কখনো মা, আম্মা, চাচির চুল পায়নি, এমনটা হতে পারে না। এই চলচ্চিত্রের শুরুতে ছোট্ট কুসুম এক ভিক্ষুককে ভাত খেতে দিচ্ছে, সেই ভিক্ষুক খাওয়ার সময়েও ভাতের মধ্যে থেকে বড় একটা আঁশ বা চুল বের করে নিচ্ছিল। এত সূক্ষ্ম যথাযথ জীবন ছবির দৃশ্য আমজাদের পক্ষেই তৈরি করা সম্ভব।

বৃদ্ধ ভিক্ষুককে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি অভিনয় করছেন। অবাক চোখে ভিক্ষুককে খেতে দেখা, ছোট্ট কুসুমের মুখে সহানুভূতির সংলাপ ‘আমার মা নাই, তোমারও মা নাই, খাও’ হৃদয় বিগলিত করে দেয়। আমজাদ ছিলেন সংলাপ তৈরির শ্রেষ্ঠ কারিগর। অনেক সময় সিনেমার শুটিং চলাকালে সামান্য অবসরেও তিনি মাজাঘষা করে দৃশ্য অনুযায়ী চরিত্রের মুখের সংলাপ তৈরি করতেন এবং চরিত্রের মুখে সহজ করে তা ধরিয়ে দিতেন।

ছোট্ট কুসুমের নতুন চাচি এসেছে। বড় চাচি কথায় কথায় কুসুমকে শাসন করে, মারে, সারা দিন খাটায়। এই নতুন চাচি একেবারে বিপরীত, যেন প্রকৃত কুসুমের মা। আদরে–সোহাগে কুসুমকে আগলে রাখবে। সেই নতুন বউ চাচির রাঙা চরণ, রাঙা বরন, লাল টুকটুকে মুখ দেখে কুসুম নাম দেয় লাল চাচি। লাল চাচির কাছে নিজের পা রাঙাবে বলে আলতা চায়। অধিকাংশ মানুষের ধারণা হিন্দুদের পুজোতে আলতা লাগে, হিন্দু বাড়ির বউ বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীদিনে গৃহলক্ষ্মীর মতো আলতা দিয়ে পা রাঙায়, আলতা বোধ হয় শুধু হিন্দুদের প্রসাধন। আসলে তা নয়, আলতা রাঙা পা বাঙালি জনজীবনে হিন্দু–মুসলিম সবারই চরণচিহ্ন। চিরকালের রাঙানো জীবন।

আবার এই চলচ্চিত্রে তখনকার নিতান্তই গ্রামীণ মুসলিম সাধারণ পরিবারের ছবি উঠে এসেছে। পুরুষদের মাথায় মুসলমানি টুপি থাকলেও, কোনো নারীর পরনে হিজাব বা বোরকা নেই। এই গ্রামীণ চাচি, ফুফু, ভাবি, বুবুরাও কত সুন্দর সাজগোজ করত। বাইরে বেরুলেও নিজের মুখ ঢাকার প্রয়োজন হতো না।

কুসুমের বোন ঝর্ণা শহরে গিয়ে পড়াশোনা করেছে। ছবি তুলতে পারে। ব্যাডমিন্টন খেলে। গ্রামীণ বিএ পাস যুবক কাজলের বাবা তাই ঝর্ণাকে পুত্রবধূ করতে চায়। কিন্তু কাজল যে মন দিয়ে ফেলেছে বাপ-মা মরা কুসুমকে। কুসুমও কাজলকে ভালোবাসে। এই কাজল আর কুসুম মানে রাজ্জাক–শাবানা, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগতে চিরকালের রোমান্টিক জুটি। কত প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মনে–মননে, প্রেমের জোয়ারে ভেসে চলার বাতাবরণ তৈরি করে এসেছে। ঝর্ণা চরিত্রে নূতন, লাল চাচি আনোয়ারা, বড় চাচি সুমিতা দেবী, কুসুমের বাবা আশীষ কুমার লোহ, চাচা জালাল উদ্দীন রুমী, গুনাই প্রবীর মিত্র—প্রত্যেকেই কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পী।

আবার পণপ্রথার ব্যাধি তখনকার গরিব মেয়ে এবং পরিবারকে কতটা ভোগাত, তারও সুস্পষ্ট ছবি উঠে আসে আমজাদের গল্পে। অসুস্থ কুসুম একদিন হারিয়ে যায়। গ্রামের লোকেরা চাচা-চাচিকে দোষারোপ করে। চাচাকে ভর্ৎসনা করে, নামাজ পড়তে পড়তে কপাল কালো করে ফেলেছ, নিজের বাড়ির মেয়েকে ধরে রাখতে পার না? কন্যা হারানোর যন্ত্রণায় ধর্মপ্রাণ চাচা, আত্মগ্লানিতে ভুগে নামাজের আসনেই দেহত্যাগ করে। অন্যদিকে, কাজলের বাবা ছেলের অমত সত্ত্বেও ঝর্ণার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলে। বিয়ের জন্য প্রচুর টাকা পণ ধার্য হয়। বিয়ের দিন লাল চাচি অল্প টাকা দেয়, বাকি টাকা পরে জমি বিক্রি করে দেবে বলে।

কাজলের লোভী বাবা তাতেও রাজি হয়; কিন্তু বাবাকে শায়েস্তা করার একটা সুযোগ পেয়ে কাজল বেঁকে বসে। পুরো টাকা যৌতুক না নিয়ে সে বিয়েতে কিছুতেই কবুল করবে না। লাল চাচি কাকুতি–মিনতি করে রাজি করাতে চায়। এর মধ্যে অবশ্য অসুস্থ কুসুম ফিরে আসে। সবাই ঘরের মেয়েকে ফিরে পায়। কাজল মনের মানুষকে ফিরে পায়।

পণের নেওয়া টাকা ফিরিয়ে দিয়ে, একটা টাকাও পণ না নিয়ে এবার কাজল কুসুমকে বিয়ে করবে। সামাজিক পণপ্রথার বিরুদ্ধে ব্যক্তির প্রতিবাদ উঠে আসে। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন ঘোষিত হয়। যেভাবে আমজাদ হোসেনের মতো লেখক, চিত্রপরিচালক, বুদ্ধিজীবী ব্যক্তি মানুষেরা সমাজে পরিবর্তন আনতে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের মানুষ আজও দুঃখভরা চিত্তে একটি গান গেয়ে ওঠে, বারবার গেয়ে ওঠে, ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই/ মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই/ এই মানুষের ভিড়ে আমার সেই মানুষ নাই।’ মর্মস্পর্শী কালজয়ী এই গানটি লিখেছিলেন আলাউদ্দিন আলী। মিতালী মুখার্জির কণ্ঠে গানটি প্রাণ পেয়েছিল। আমজাদ হোসেন এই চলচ্চিত্রে ব্যবহার করে গানটিকে বাঙালির শিরায় শিরায় প্রবাহিত করে দেন। ‘দুই পয়সার আলতা’–এর সংগীত পরিচালনা করেছেন আলাউদ্দিন আলী। অন্য গানগুলো লিখেছেন আমজাদ হোসেন ও নজরুল ইসলাম বাবু। মিতালী মুখার্জি ছাড়াও কণ্ঠ দিয়েছেন কিংবদন্তি সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদী ও আলাউদ্দিন আলী।

আজকের এই দুনিয়ার মধ্যে সেদিনকার সেই দুনিয়াকে খুঁজে পেতে, মানুষের মধ্যে মানুষকে খুঁজে পেতে ‘দুই পয়সার আলতা’র মূল্য তাই কখনো ফুরোনোর নয়। বাঙালি জনজীবনে চিরকালের।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত