মা–বাবার একমাত্র সন্তান আমি। পড়ালেখার বদৌলতে থাকি বগুড়ায়। সরকারি আজিজুল হক কলেজে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত থাকায় ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখগুলোর মধ্যে আমিও একজন। জনপ্রিয় মুখের মধ্যে আরেকজন আমার বন্ধু শাওন। জনপ্রিয় বললে ভুল হবে; বলতে হবে জনপ্রিয়াদের প্রিয় মুখ। শাওন আর আমাকে সবাই দুই শরীরে এক মানুষ বলে থাকে। আমার জীবন এভাবেই চলছিল। ক্যাম্পাস, সংগঠন, শাওন, আব্বু আর আম্মু—এ নিয়েই জীবন। ও হ্যাঁ, আরও একজন আছে, স্নিগ্ধা! ও আমার একপক্ষীয় ভালোবাসা। উচ্চমাধ্যমিকের সময় থেকে ওকে বলব বলব করছি, অথচ আজও বলা হয়ে ওঠেনি। সে–ও জানে সব, তবু কিছুই বলে না। মেয়েদের বুক ফাটে, কিন্তু মুখ ফোটে না বলে একটা প্রবাদ আছে।
সবকিছুই দারুণ চলছিল, শুধু সেদিন ঢাকা যাওয়ার আগপর্যন্ত।
বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার জন্য নিয়মিত ঢাকায় যাতায়াত হতো। সমাজসেবা অধিদপ্তরের একটা পরীক্ষা দিতে যাই ঢাকার আগারগাঁওয়ে। শুক্রবার পরীক্ষা দিয়ে রাতের ট্রেনেই ফিরে যাব। পরীক্ষার হলে ঢুকে বুঝলাম, দেশে চাকরির বাজার অনেক কড়া। ছোট একটা পদের জন্য স্নাতক শেষ করা বহু মানুষ এসেছে পরীক্ষা দিতে। আমার যে এখানে কিছু হয়ে উঠবে না তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। বিষাদগ্রস্ত না হয়ে বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাতের একটা পরিকল্পনা করি। দু-একজন ছাড়া সবাই এল। জমিয়ে আড্ডা হলো। তারপর বুকভর্তি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চলে এলাম ঢাকা বিমানবন্দর। সেদিন বুঝতে পারলাম আমরা স্বভাবতই লোভী। বন্ধুরা নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে; অথচ তারা কেউ খুশি নয়। সবাই যেন মরীচিকার পেছনে ছুটছে। তাহলে কি আমি ভালো আছি ওদের থেকে? হয়তো আছি, হয়তোবা নেই!
একটা পানির বোতল আর একটা জুস নিলাম। লোকে গিজগিজ করছে স্টেশনে। একটু বসে যে কোমরটা সোজা করে নেব, তেমন অবস্থা নেই। উপায় না পেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ট্রেন আসতে এখনো ঘণ্টাখানেক দেরি। ভাবলাম স্নিগ্ধার সঙ্গে কথা বলে নিই একটু। ফোন দিলাম। কিন্তু ব্যস্ত দেখাচ্ছে। জানি কিছুই হয়নি। তবু ভালো লাগল না কেন জানি। হয়তো প্রিয় মানুষ সে জন্যই। এসব ভাবতে ভাবতেই একটা ছোট্ট হাত এসে শার্ট টেনে ধরল। তাকাতেই দেখি, পাঁচ-ছয় বছরের একটা ছেলেশিশু শার্ট টেনে ধরে অপলক তাকিয়ে আছে। বুঝতে বাকি রইল না তার উদ্দেশ্য।
- কিছু বলবে? নাম কী তোমার?
- কয়ডা টাকা দিবেন? কিছু খাব।
- কী খাবে বলো?
- আপনি টাকা দেন।
- কী খাবে বলো, আমি কিনে দিচ্ছি।
সে আর কিছু বলে না। আমার কাছ থেকে কিছু না পেয়ে সামনের ব্যক্তির কাছে চলে গেল। তিনিও সামনে এগোতে বললেন। তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে কেকের প্যাকেটটা বের করে নিলাম। ট্রেনে খাব বলে নিয়েছিলাম।
- এই নাও। এটা খেয়ে নিয়ো। আর এই জুস রাখো, সেটিও খাইয়ো। আর কিছু নেবে?
- টাকা দিবেন না?
তাকে আর কিছু বলতে পারিনি। আমি যে টাকা দিতে চাচ্ছি না, সেটা হয়তো সে বুঝতে পারছে না কিংবা বুঝতে পেরেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষের চেষ্টার তো আর শেষ নেই। ছেলেটা হাঁটতে হাঁটতে সামনে চলে গেল। কাউকে আর টাকার জন্য জিজ্ঞেস করছে না। তাহলে কি সে আসলেই না খেয়ে ছিল? পিছু নিতেই দেখি সে তার মায়ের কাছে দৌড়ে গিয়ে জুস আর কেকের প্যাকেটটা দিল। মায়ের সঙ্গে আরেকজন কমবয়সী মেয়ে ছিল, ছেলেটার বোন হবে হয়তো। কেক পেয়ে মেয়েটা অনেক খুশি হলেও মা জুসের বোতলতা ছুড়ে মেরে ছেলেটার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকি কিছক্ষণ। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে জুসের বোতলটি নিতে আসে। ছেলেটার হাতে বোতলটা তুলে দিয়ে বললাম। শুধু শুধু ওকে মারছেন কেন?
- আমার পোলারে আমি মারি–কাটি আমার ব্যাপার, আপনে কে?
- আমি কেউ না। তাই বলে আপনি এই অবুঝ বাচ্চাটারে মারবেন?
- এতই যদি দরদ তাইলে টাকা দিয়ে ভাগেন না কেন? আইছে দরদ দেহাইতে। গোলামের পুতেরে কইছিলাম একটু ভালো কইরা টাকা চাবি তাইলে দিব। খাওয়াইয়া মোটা করছি তো তাই ভিক্কা পাস না। খাড়া তোরে দুই দিন না খাওয়ায় রাখুম, তারপর দেহি টাকা কেমনে না কামাইতে পারস। তুই এহানে বসে বসে কী গিলতাছস? তোর কাম নাই?
দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে ট্রেন। উল্টো পাশে জানালার ধারে সিট পড়েছে। স্নিগ্ধ হাওয়া আর শরীরের ক্লান্তি নিয়ে সিটে বসামাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছি। আচমকা একটা হাত এসে ডাকল আমায়। দেখলাম এক মধ্যবয়সী নারী আর সঙ্গে একজন মেয়ে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
বুঝতে বাকি রইল না যে টাকার পরিবর্তে খাবার নিয়ে যাওয়ায় মার খেতে হলো। ছেলেটাকে একটা ১০০ টাকার নোট বের করে দিয়ে উল্টো পথে হাঁটা দিলাম। এর বেশি কিছু দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। চোখগুলো ছলছল করছিল। চশমা খুলে চোখ মুছতেই দেখি স্নিগ্ধার ফোন। নিমিষে হাসি ফুটল প্রাণে। কী এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে ও ফোন দিলেই। মাত্র একটা ফোনকল আমার সব মানসিক অস্থিরতা দূর করে দেয়।
ভালো-মন্দ, নাওয়া-খাওয়া নিয়ে কথা চলছিল। আবিষ্কার করলাম সারা দিনে মাত্র একবার খাওয়া হয়েছে আমার। স্নিগ্ধা বিষয়টা জানতে পারলে আমায় আর আস্ত রাখবে না। ট্রেন আসতে এখনো ৩০ মিনিটের মতো বাকি। একটু তাড়াহুড়া করলেই খেয়ে আসা যায়। ফোনকল কেটে দৌড় দিয়ে চলে গেলাম পাশের হোটেলে। একটা টেবিলের দুটি পাশাপাশি সিট ফাঁকা। সেখানে গিয়ে বসলাম। লক্ষ করলাম, পেছনের টেবিলে দুজন পুলিশ অফিসার ও দুজন ট্রেন কর্মকর্তা আছেন। খাবারের দিকে মন দিতেই শুনতে পাই পুলিশদের কথোপকথন,
- দেখুন স্যার, আমরা জানি এটা আপনাদের জন্য জরুরি। কিন্তু এটা অনৈতিক আর আমাদেরও তো চাকরির ভয় আছে নাকি?
- আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। আমাদের রেল পুলিশ সব কাজ সামলে নেবে। আপনাদের কাজ হলো ট্রেন নিয়ন্ত্রণ করা।
- ট্রেন না–হয় নিয়ন্ত্রণে রাখব; কিন্তু যাত্রীদের তো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব না। কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা হয়ে যাবে।
- কেউ বিন্দুমাত্র টের পাবে না। সবাই স্বাভাবিক মানুষের মতোই থাকবে। আর আপনার কি পরিবারের মায়া নেই নাকি? দেখুন এই কাজের বিনিময়ে আপনি কতগুলো টাকা পাচ্ছেন, আপনার মেয়ের প্রাইভেট মেডিকেলে পড়াশোনা, ছেলেটা তো এবার নটর ডেমে তাই না?
- আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তাহলে উঠি, ট্রেনের সময় হয়ে গেছে।
তাদের কথা শুনে থমকে গেছি। গলা থেকে খাওয়া নিচে নামছে না। হাজারটা প্রশ্নে মাথাবিভ্রাট ঘটছে। তড়িঘড়ি করে খাওয়া শেষ করে পিছু নিলাম ট্রেন কর্মকর্তার। অনেকক্ষণ খোঁজার পরে দেখলাম, তিনি খাবার ঘর কেবিনের মধ্যে অন্য কর্মকর্তাদের কিছু নির্দেশনা দিচ্ছেন। এর মধ্যে শামিম ও রনি নামের দুজন কর্মীকে রেল পুলিশের সঙ্গে যেতে বলল। পুলিশদের পিছু নিলাম। মোবাইল হাতে নিয়ে চুপি চুপি ছবি তুলছি তাদের। এরই মধ্যে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এল। কাকতালীয়ভাবে তারা আমার কামরায় এসে গল্প করছিল। আমি আমার সিটের ওখানে ব্যাগটা রেখে চলে আসব, এমন সময় পাশে বসা ভদ্রলোক বললেন, এটা দিনাজপুর কখন পৌঁছাবে?
- সেকি চাচা, এই ট্রেন দিনাজপুরে যাবে কেন? এটা তো বগুড়া হয়ে রংপুর যাবে।
- কিন্তু আমাকে যে বলল ১১টার ট্রেনটা দিনাজপুর যাবে।
- ১১টা তো বাজেনি এখনো। এখন মাত্র ১০টা ১৫ মিনিট।
- এই যে দেখ ১১টা ৫ বাজে।
তার মোবাইল দেখে বুঝলাম যে সময় নষ্ট হয়ে আছে। সেটা ঠিক করে দেওয়ার সময় ছিল না। লম্বা লম্বা আওয়াজ তুলে ট্রেন ছেড়ে দিল। আমি শুধু তার ব্যাগগুলো নিয়ে দ্রুত নামিয়ে দিলাম। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি এ যাত্রায়। ভদ্রলোক ঠিকমতো উঠতে পারবে কি না কে জানে?
দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে ট্রেন। উল্টো পাশে জানালার ধারে সিট পড়েছে। স্নিগ্ধ হাওয়া আর শরীরের ক্লান্তি নিয়ে সিটে বসামাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছি। আচমকা একটা হাত এসে ডাকল আমায়। দেখলাম এক মধ্যবয়সী নারী আর সঙ্গে একজন মেয়ে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
- কতক্ষণ ধরে ডাকছি বাবা শুনতে পাও না?
- জি বলুন!
- তোমার পাশের সিটটা আমার পড়েছে। আমরা দুইটা সিট নিয়েছি, কিন্তু দুইটা দুই জায়গায়। তুমি বাবা যদি কিছু মনে না করো তাহলে তোমার সিটে আমার মেয়েকে বসতে দিবা?
নারীদের সব সময় সম্মানের চোখে দেখি। সাতপাঁচ না ভেবে সিটটা ছেড়ে দিলাম। তারা ধন্যবাদ দিয়ে বসে পড়লেন। আমি ব্যাগ নিয়ে ওনার দেখানো সিটে বসলাম। সেখানেও এক ঝামেলা। মেয়ের বাসা থেকে মধ্যবয়সী এক দম্পতি বাসায় ফিরছিলেন। নামবেন শান্তাহার ক্রসিংয়ে। তাঁদের সিট আবার পড়েছে তিন সিটের দুই দিকে। অর্থাৎ আমার সিট মধ্যখানে পড়েছে। তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরে বললাম, আপনারা চাইলে পাশাপাশি বসতে পারেন। চাচি রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমার বয়েই গেছে ওনার সঙ্গে বসার।’ এই বলে মুখ বাঁকিয়ে বাইরে আকাশ দেখছেন। বুঝতে পারলাম, চাচার কপালে আজ দুঃখ আছে। সিটে একটু হেলান দিয়ে ভাবছি কী হচ্ছে এসব আমার সঙ্গে আজ? এতটা নাটকীয় অবস্থায় কখনোই পড়িনি। একজন ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছে, একজনের বৈবাহিক ঝগড়া চলছে, আরেকজনের জন্য সিটটাই ছেড়ে দিলাম। স্টেশনে শিশুটির ঘটনা কিংবা সেই পুলিশের কথোপকথন; কী সব হচ্ছে আমার সঙ্গে!
পুলিশের ঘটনাটা মনে পড়াতে সিট থেকে উঠে হাঁটা দিলাম তাদের খোঁজে। দ্রুতগতিতে ট্রেন এগিয়ে চলছে। একটু পরই জয়দেবপুর জংশনে পৌঁছে যাব। বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর, টাঙ্গাইলের জন্য অনেক যাত্রী উঠেছে। লোকজনে গিজগিজ করছে। একটু যে সামনে এগিয়ে যাব, তার উপায় নেই। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে সিটে এসে বসি। শাওন ও জাফর ভাইকে ছবিগুলো পাঠিয়ে দিলাম। জাফর সাদিক ভাই দেশের স্বনামধন্য পত্রিকার বগুড়া প্রতিনিধি। শাওন ফোন দিল,
- কই আছিস তুই?
- এই তো জয়দেবপুর ঢুকতেছি।
- কিসের ছবি পাঠাইলি এগুলো? কিছুই তো বুঝলাম না।
- আরে কী যে হচ্ছে বুঝতে পারছি না। গিয়ে তোকে সব খুলে বলব। জাফর ভাইয়াকে ছবিগুলো পাঠিয়েছি। উনি এখনো দেখেননি।
- আচ্ছা প্যারা নাই। তুই আয়, স্নিগ্ধাকে ফোন দিস। ও বাসায় যাবে মনে হয় কাল।
- কই আমাকে তো কিছু বলল না। আচ্ছা ফোন দিব।
- আচ্ছা ঠিক আছে। কোনো দরকার হইলে জানাইস।
কথা আর বাড়াইনি। শাওনের স্বভাবের সঙ্গে আমি পরিচিত। ফোন রাখতেই জয়দেবপুর জংশনে পৌঁছে গেলাম। এই জংশনে এলেই একটি মজার ঘটনা মনে পড়ে।
একবার রিয়াদ আমি আর শাওন একসঙ্গে ঢাকা যাচ্ছিলাম। রিয়াদের কোনো এক বড় ভাই নাকি গাজীপুরে ডুয়েটে পড়াশোনা করেন। ওনার সঙ্গে দেখা করবে রিয়াদ। স্টেশনে যেহেতু ট্রেনটা বেশকিছুক্ষণ দাঁড়ায়, সেহেতু দেখাসাক্ষাতের সঙ্গে হালকা চা–নাশতাও হয়ে গেল। ভাইকে বিদায় দিয়ে ট্রেনে উঠতে যাব, এমন সময় রিয়াদের প্রাকৃতিক চাপ আসে। এদিকে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এল। তাকে বললাম ট্রেনে চল, সেখানেই কাজ সেরে নিস। কিন্তু সে কোনো কথা না শুনে দিল মসজিদে দৌড়। তাকে অনেকক্ষণ তাড়া দিলাম। ট্রেন ছাড়ার জন্য হর্ন দেওয়ামাত্রই সে প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন না করে বলে চল, আমরা দৌড়ে এসেও ধরতে পারিনি ট্রেন। রিয়াদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম অপবিত্রতা তাকে গ্রাস করেছে। আমরা হাসব নাকি বিরক্ত হব বুঝতে পারছিলাম না।
চলবে…
তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক, দিনাজপুর বন্ধুসভা