অনন্তের পথে যে যাত্রা

পরিবারের সঙ্গে আলাউদ্দিন খোকনছবি: সংগৃহীত
তাঁর কথা ভাবলেই একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে, আর তা হলো শহীদজননী রমা চৌধুরীর হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। ১৯৯৪ সাল থেকে তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে পাশে ছিলেন খোকন ভাই। দীর্ঘ ২৪ বছর কখনো ভাইয়ের মতো দায়িত্ব নিয়ে আগলে রেখেছিলেন, কখনো ছেলের মতো স্নেহ-মমতায় পাশে ছিলেন।

৪ সেপ্টেম্বর ঘড়ির কাঁটায় বেলা ১১টা। চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে জড়ো হয়েছেন শত শত মানুষ। সূর্যের প্রখর চোখরাঙানি বলছিল, ‘ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে’। শরতের এই তীব্র খরতাপকে উপেক্ষা করেই ছুটে আসেন সবাই। কারও হাতে ফুল, কেউবা অশ্রুভেজা চোখে আসেন প্রিয় মানুষকে একনজর দেখতে।

সবার সেই প্রিয় মানুষ এলেন কফিনে বন্দী হয়ে। অথচ ঠিক দুই দিন আগেই তিনি শিল্পকলা প্রাঙ্গণে সবার সঙ্গে মেতেছিলেন আড্ডায়। মানুষটি চট্টগ্রাম বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি আলাউদ্দিন খোকন। আমাদের আত্মার আত্মীয়। তাঁর মরদেহবাহী গাড়ি যখন শিল্পকলা একাডেমিতে প্রবেশ করল, সবার মুখে নেমে এল বিষাদের ছায়া। একাডেমির প্রশাসনিক ভবনের সামনে স্থাপন করা মঞ্চে শোয়ানো হলো খোকন ভাইকে। চারপাশে অপেক্ষমাণ মানুষ। কেউ কেউ খোকন ভাইয়ের শেষ শয্যায় ফুল দিয়ে যাচ্ছেন, কেউবা নীরবে কাঁদছেন। কেউ তাঁর আত্মীয়, কেউবা বন্ধুবান্ধব, আবার কেউ সাধারণ মানুষ, সংস্কৃতিকর্মী, সংগঠক আবার কেউবা সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা। সেদিন চট্টগ্রামের নানা জায়গা থেকে মানুষ এসে ভিড় করেন খোকন ভাইকে শেষবারের মতো দেখতে।

শিল্পকলা থেকে তাঁকে নেওয়া হলো ফিরোজশাহ কলোনি এলাকায়। নামাজে জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন হলো পূর্ব ফিরোজশাহ কলোনি সিটি করপোরেশন কবরস্থানে।

১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম বন্ধুসভা যে কয়েকজন মানুষের হাত ধরে যাত্রা শুরু করেছিল, তাঁদের একজন খোকন ভাই। নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন শেষে সভাপতি ছিলেন ২০০৮-০৯ সালে। তাঁর হাত ধরে দক্ষ সংগঠক হিসেবে তৈরি হয়েছেন অসংখ্য তরুণ। যারা বর্তমানে দেশ-বিদেশে নানা পেশায় যুক্ত। আলাউদ্দিন খোকনের মৃত্যুতে সারা দেশের বন্ধুরা শোকাহত। খোকন ভাইয়ের হৃদয় ছিল আকাশের মতো বিশাল। আপন করে নিতে পারতেন সবাইকে। তাঁর কথা ভাবলেই একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে, আর তা হলো শহীদজননী রমা চৌধুরীর হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। ১৯৯৪ সাল থেকে তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে পাশে ছিলেন খোকন ভাই। দীর্ঘ ২৪ বছর কখনো ভাইয়ের মতো দায়িত্ব নিয়ে আগলে রেখেছিলেন, কখনো ছেলের মতো স্নেহ-মমতায় পাশে ছিলেন।

২০০৫ সালের মার্চ মাসে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে আক্রান্ত হন রমা চৌধুরী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেড় মাস অনিদ্র রাত কাটিয়ে মৃত্যুর কবল থেকে দিদিকে কেড়ে এনেছিলেন খোকন ভাই। তখন তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক। বন্ধুসভার বন্ধুরাও তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সেবা-শুশ্রূষা করেছিলেন।

খোকন ভাইয়ের প্রাণশক্তি আমাদের প্রেরণা জোগাত। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা দেখে বিস্মিত হতাম। আমাদের বিস্মিত করেই তিনি হঠাৎ চলে গেলেন। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান আলাউদ্দিন খোকন। ঠিক পাঁচ বছর আগে এই দিনেই খোকন ভাই হারিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় রমা দিদিকে। সে কারণেই কি রমা চৌধুরী চলে যাওয়ার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনেই দূর আকাশের তারা হয়ে গেলেন তিনি! তাঁর এই অনন্তের পথে যাত্রা কী করে মেনে নেবেন তাঁর সহধর্মিণী আর দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েটি!

উপদেষ্টা, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা