শাসনের মুখোশ খুলে দেওয়া এক স্বাধীন কণ্ঠ ‘তাণ্ডব’

‘তাণ্ডব’ সিনেমার দৃশ্যছবি: সংগৃহীত

একটি টিভি চ্যানেলে আবহাওয়ার খবরের পর একজন মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার লাইভ চলাকালীন হঠাৎ ঘটে ছন্দপতন—বুলেটের শব্দে মুহূর্তেই বদলে যায় দৃশ্যপট। মাঙ্কি মাস্ক পরা একদল অস্ত্রধারী স্টুডিও দখলে নেয়। তাদের নেতা স্বাধীন। যে মুহূর্তে স্বাধীন (শাকিব খান) সরাসরি সম্প্রচারে গুলি চালিয়ে খুন করে বসে দেশের এক মন্ত্রীকে। ঠিক সেই মুহূর্তে দর্শক চমকে ওঠে।

ধীরে ধীরে খুলতে থাকে গল্পের জট। স্বাধীন আসলে কে? কেন এমন কাণ্ড ঘটাল? সে মুক্তিপণ চায় না। তবে চারজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হাজির করতে বলে—ধর্মমন্ত্রী, সাবেক আইজিপি, একটি টিভি চ্যানেলের কর্ণধার ও একজন সাংবাদিক। এ চারজনই যেন একটা রাষ্ট্রযন্ত্রের চারটি চাকা, যাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বাধীন খুলে বসে তার অতীত, তার যন্ত্রণার ইতিহাস।

স্বাধীন একসময় ছিল এক সাধারণ যুবক। যার স্বপ্ন ছিল, প্রেম ছিল, একটা স্বাভাবিক জীবন ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র তাকে পিষে দিয়েছে, গিলে ফেলেছে স্বপ্ন। এই অবস্থান থেকে দাঁড়িয়ে স্বাধীন তার মঞ্চ বানিয়ে নেয় টেলিভিশন স্টুডিওকে। সাংবাদিক সায়রা (জয়া আহসান) এই কাহিনির ন্যারেটর হয়ে ওঠে, যে সাহসিকতার সঙ্গে সামলায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি।

পরিচালক রায়হান রাফী স্পষ্ট ভাষায় কোনো রাজনৈতিক পক্ষকে আঙুল দেখাননি, তবে প্রতিটি দৃশ্য যেন ইঙ্গিতে বলে—কিছু মন্ত্রীর আমলনামা, বানরের নাচে যেন সরকার দেশের জনগণকে নাচাচ্ছে।

অভিনয় প্রসঙ্গে আসা যাক। শাকিব খান তাঁর ক্যারিয়ারের এক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছেছেন ‘তাণ্ডব’-এ। একই চরিত্রে দুটি রূপ—একদিকে অব্যক্ত কষ্টে জর্জরিত তরুণ, অন্যদিকে ভয়াল নির্ভীক ‘সন্ত্রাসী’ নেতা—দুটি রূপেই তিনি ছিলেন বিশ্বাসযোগ্য। বিশেষ করে তাঁর কণ্ঠের পরিবর্তন, সংলাপের টান আর চোখের অভিব্যক্তি চরিত্রটিকে করে তুলেছে বাস্তব।

জয়া আহসান বরাবরের মতোই মুগ্ধ করেছেন। সাংবাদিক সায়রার ভূমিকায় তিনি ছিলেন দৃঢ়, সংবেদনশীল ও মানবিক। সাবিলা নূর বাণিজ্যিক ছবিতে প্রথম হলেও নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন। যদিও পর্দায় তাঁর সময় সীমিত ছিল, তবু শাকিবের সঙ্গে গানের দৃশ্যগুলোয় তাঁদের রসায়ন ছিল নজরকাড়া।

অন্য অভিনেতাদের মধ্যে আফজাল হোসেন, শহীদুজ্জামান সেলিম, গাজী রাকায়েত প্রত্যেকেই তাঁদের জায়গায় বিশ্বস্ত ছিলেন। সোয়াট টিমের নেতৃত্বে এফ এস নাঈম তাঁর সীমিত সময়েও ভালো প্রভাব তৈরি করেছেন।

সিনেমার সংগীত ও আবহসংগীত এককথায় অসাধারণ। আরাফাত মহসীনের আবহ একেকটি দৃশ্যকে করে তোলে শ্বাসরুদ্ধকর। বিশেষ করে ‘খবর দে’ গানটি যেন পুরো সিনেমার অনর্গল চিৎকার হয়ে ওঠে।

সিনেমার কিছু জায়গা মনে হচ্ছিল দ্রুত এগোচ্ছে, আবার কখনো কিছুটা ধীরগতির মনে হয়েছে। স্বাধীনের অতীত ও বর্তমানের মধ্যে লুকের আরও পরিবর্তন দরকার ছিল। কিছু জায়গায় সোয়াট টিমের কৌশল আর প্রস্তুতি প্রধান চরিত্রের তুলনায় ছিল দুর্বল। তবে সব ছাপিয়ে ‘তাণ্ডব’ এমন একটি সিনেমা, যা বিনোদনের আড়ালে প্রশ্ন রেখে যায় সচেতন মস্তিষ্কে।

সবচেয়ে বড় চমক—সিয়াম ও আফরান নিশোর বিশেষ উপস্থিতি। সিয়ামের ভয়াল চাহনি ও নিশোর অতীত থেকে বর্তমানের কানেকশন—সবই বলে দেয়, এখানে শুধু একটা গল্প শেষ হয়নি, একটা সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের সূচনা হয়েছে। পরের পর্বে হয়তো দেখা যাবে স্বাধীন বনাম মাসুদ—প্রতিস্পর্ধী দুই আদর্শ। হয়তো ভবিষ্যতে আমরা পেতে যাচ্ছি চমৎকার কিছু সিকুয়েল। কয়েকটি ইন্টারভিউয়ে পরিচালক রায়হান রাফীর কথা এবং তাঁর পরিচালিত কয়েকটি সিনেমা এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা