আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি

আনোয়ার হোসেনের তোলা এই ছবিটি হয়ে উঠেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের প্রতীক। ১৯৭১–এ এটি তোলা হয়েছিল ঢাকার দোহারের একটি গ্রাম থেকে

তারুণ্যের ভাষা ভিন্ন। এর কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, নেই বয়স। তরুণ বয়সে মানুষ সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল, প্রগতিশীল ও সচেতন থাকে। আমাদের ইতিহাসে তরুণেরাই সব সময় সাম্যের গান গেয়ে এসেছে এবং প্রতিবাদের ভাষা হয়েছে তারুণ্য। শক্তি আর সাহসের উদাহরণ মানেই তারুণ্য। এই তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানেই দেশপ্রেমের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

তরুণ প্রজন্মের একজন হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে দেখি আত্মশক্তির প্রতীক রূপে, যার মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি, পেয়েছি একটি চিরস্বাধীন পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু ইতিহাসই নয়, এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য শক্তি, সাহস, প্রেরণা এবং সব বাধার মুখে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মহান মন্ত্র। মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মাত্র কয়েকটি রাষ্ট্র যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের দেশকে স্বাধীন করেছে। বাংলাদেশ সেদিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে আছে। কারণ, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের অধিকার ও অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে বাঙালি জাতির। যদিও বিশ্বের মানচিত্রে খুব ছোট দেশ প্রিয় বাংলাদেশ। তবে এই দেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সমৃদ্ধ ও তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাসংগ্রামকে বলা হয় ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’, কিন্তু আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’। যেখানে মুক্তি অর্থ সব পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে নিজের অস্তিস্ত প্রমাণ করার মুক্তি, স্বাধীনভাবে নিজের মাটি, বায়ু-প্রকৃতির স্বাদ আস্বাদনের মুক্তি; এ মুক্তি সব শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি। এ মুক্তি পরাধীনতা থেকে মুক্তি, শিকল থেকে মুক্তি, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পীড়ন থেকে মুক্তি। এ মুক্তির জন্য আমাদের অগ্রজরা যুদ্ধ করেছিলেন। অস্ত্র হাতে নিয়ে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন একটি লাল-সবুজ পতাকার জন্য।

বঙ্গবন্ধুর সেই অমর বাণী—‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’ যেন সত্য হয় তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই। বাংলাদেশ যেন বিশ্বের বুকে অদমনীয় হয়েই এগিয়ে যেতে পারে। তারুণ্যের শক্তি যেন সব দুর্নীতি, অন্যায় থেকে দেশকে মুক্ত করে, সেটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

আমাদের কাছে রক্তঝরা মার্চ মাসের রয়েছে অন্য রকম আবেদন। এটি অগ্নিঝরা ইতিহাসের মাস, বিষাদ ও বেদনার মাস। এ মাসেই লেখা শুরু হয়েছিল এক অমর মহাকাব্য, যার নাম বাংলাদেশ। বাঙালির জীবনে ভাষা আন্দোলনের স্মারক মাস ফেব্রুয়ারির পর মার্চের গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয়। তাই ভাষা ও স্বাধীনতাসংগ্রাম যেন একই সুতায় গাঁথা।

‘৬৯-এর গণ–অভ্যুত্থানের পর এ দেশ যে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে এগোচ্ছিল, তা স্পষ্ট হয়ে যায় এই মার্চেই। একাত্তরের গোটা মার্চ মাসই ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। এ মাসেই নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে জেগে উঠেছিল মুক্তিকামী কোটি জনতা। একাত্তরের মার্চ ছিল মুক্তিকামী জনতার আন্দোলনে উত্তাল। বাংলা ছিল অগ্নিগর্ভ। উত্তাল এই মাসের প্রতিটি দিনই বাঙালি জাতির জন্য অনুপ্রেরণা আর শক্তির উৎস। ১৯৭১ সালের মার্চে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা তরুণ প্রজন্মের জন্য প্রেরণাদায়ক। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এ ভাষণেই তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

২৫ মার্চ বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর শুরু হয় মুক্তির সংগ্রাম। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফসল স্বাধীনতা। এটি অর্জনের জন্য সীমাহীন ত্যাগ–তিতিক্ষা করতে হয়েছে, ঝরাতে হয়েছে তাজা রক্ত, দিতে হয়েছে প্রাণ। অবশেষে অর্জিত হয় স্বাধীনতা নামের রক্তিম সূর্য। তবে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ অভিন্ন এক লক্ষ্য নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এক হয়েছিল। স্বাধীনতার এত বছর পর এসে কি সেই ঐক্য ধরে রাখতে পেরেছে তরুণ প্রজন্ম? এ প্রশ্নের উত্তর কিছুটা জটিল।

আমাদের সৌভাগ্য আমরা ভূমিষ্ঠ হয়েই একটা স্বাধীন দেশের নাগরিকের সুবিধা ভোগ করেছি। আমাদের চোখে অদেখা ছিল সাধারণ বাঙালির ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দমন, পীড়ন, শোষণ, নির্যাতন। অনেকেই জানি না, শত প্রাণের বলিদান, হাজারো অসহায় মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, শত আঘাতে ক্ষতবিক্ষত শরীরের বিনিময়ে পেয়েছি একটি পতাকা, একটি রাষ্ট্র, একটি ভূখণ্ড। তাই হয়তো এর পেছনের ত্যাগ–তিতিক্ষা অনেককেই নাড়া দেয় কম। ওই লাল-সবুজ পতাকা যে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর বীরাঙ্গনা মায়েদের শাড়ির আঁচলে জড়ানো, তা উপলব্ধি করতে পারি না অনেকেই। দেশের মানচিত্র আর জাতীয় সংগীতের পেছনে কত মানুষের অবদান লুকায়িত, তা বোঝার ক্ষমতা অনেকেরই নেই। আমরা আজ ভার্চ্যুয়াল জগৎকেই নিজেদের অস্তিত্ব বানিয়ে ফেলেছি। আজকাল একটা ভালো বই পড়া, ইতিহাস সম্পর্কে জানা, সমাজের ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে প্রশ্ন করা, মননশীলতার চর্চা খুব কমই করে মানুষ। এ প্রজন্মের কতজন ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘ওরা এগারোজন’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ দেখেছে, তা নিয়ে সন্দেহ। কিন্তু হলিউড, বলিউডের নতুন সিনেমা, নায়ক-নায়িকাদের পেশাগত, ব্যক্তিগত তথ্য—কিছুই এ প্রজন্মের অজানা হয়। কতজন ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘চিলেকোঠার সেপাই’, ‘একাত্তরের ডায়েরি’, ‘একাত্তরের দিনগুলি’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ’, ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’, ‘মা’, ‘নেকড়ে অরণ্য’, ‘বাংলাদেশ রক্তের ঋণ’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র মতো ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসবিষয়ক এসব বই পড়েছে, খুঁজলে সে সংখ্যা নগণ্যই হবে।

স্বাধীনতা এসেছে মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলস্বরূপ এই স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় একঝাঁক অলৌকিক তরুণের চেতনায়, মননে ও কর্মে তৈরি হয়েছিল বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণি ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মানচিত্র; যেখানে উগ্রবাদ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, স্বৈরাচার, অসম অধিকার, মুক্তবাক রুদ্ধতার দেখা মিলবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে সেই সব চেতনার কথা, সেই সব আকাঙ্ক্ষার কথা নির্দেশ করে, যার জন্য বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘ সময় আন্দোলন সংগ্রাম করেছে এবং অবশেষে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেছে।

২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেট অতিরিক্ত সংখ্যায় ২০১৮ সালের ৪৬ নম্বর আইন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন’–এ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ অর্থ যেসব মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্ধুদ্ধ করিয়াছিল—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সেই সব আদর্শ।’ অর্থাৎ আমরা এ কথা নির্দ্বিধায় উচ্চকণ্ঠে বলতে পারি, লাখ লাখ মানুষের রক্তস্নাত পথে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছিলাম, তার পেছনে মূল চারটি আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছিল। সেগুলো হলো—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

তরুণদের এসব চেতনায় উদ্বুদ্ব হতে হবে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে দেশ ও দশের তরে কাজ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করে দেশ গড়ার প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই দেশ উন্নত হবে, বাস্তবায়িত হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। আমাদের দেশের বর্তমানে তরুণদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার সেই আন্দোলন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য যে উদ্দেশ্য ছিল, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার সময়। স্বাধীনতার মূলমন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে দেশের প্রতিটি জিনিস নিয়ে ভাবতে হবে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে অবগত থাকা জরুরি। যখন প্রত্যেকেই তাঁর অধিকার, কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হবে, তখনই দেশ বদলানো সহজ। পরিবর্তন আসবে দেশ, জাতি, সমাজ তথা প্রতিটি ক্ষেত্রে।

দেশের অস্তিত্বের সঙ্গে যেসব চেতনা, দর্শন জড়িয়ে আছে, তা আরও ছড়িয়ে দিতে হবে। ফেসবুক-প্রজন্ম বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়, তরুণদের ওই অংশের প্রতি আরও গুরুত্ব দিতে হবে। আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নের যে পথে হাঁটছে, সেই পথ ভবিষ্যতেও পাড়ি দিতে হবে। তরুণ প্রজন্মই নেতৃত্ব দেবে আগামী দিনের বাংলাদেশ। তাই তাদের গড়ে তুলতে হবে প্রকৃত আদর্শে, যে আদর্শের তাড়নায় তারা সৎ হবে। দেশপ্রেম থাকবে অটল। প্রকৃত দেশপ্রেমের চেতনা তাদের শিরায় বইবে। এ দেশ নিয়ে তারা গর্ব করবে। নোংরা রাজনীতি করা অসুস্থ প্রজন্ম নয়, মেধাবী ও সৎ সন্তানেরাই দেশ গড়তে পারবে স্বপ্নের সমান করে। মনে রাখতে হবে, আমাদের পূর্বপুরুষদের ত্যাগ যেন বৃথা না যায়। এত শহীদের রক্তে গড়া দেশটা যেন অপশক্তির হাতে আর শোষিত না হয়। দেশ গড়ার দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস যেন বিস্মৃতির চাদরে ঢাকা না পড়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর সেই অমর বাণী—‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’ যেন সত্য হয় তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই। বাংলাদেশ যেন বিশ্বের বুকে অদমনীয় হয়েই এগিয়ে যেতে পারে। তারুণ্যের শক্তি যেন সব দুর্নীতি, অন্যায় থেকে দেশকে মুক্ত করে, সেটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা। শুধু তরুণ প্রজন্ম নয়, প্রতিটি প্রজন্মই যেন বুকে হাত দিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারে—আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

উপদেষ্টা, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা