‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ একটি জনপ্রিয় গানের অংশ। কালজয়ী ‘সারেং বউ’ চলচ্চিত্রে ‘ওরে নীল দরিয়া..’ দুঃখ, বিরহ, যন্ত্রণাকাতর গানটি শুনে কষ্ট পাননি, এমন বাঙালি খুব কম আছে। ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া/ মরি আমি ধড়ফড়াই রে/ দারুণ জ্বালা দিবানিশি অন্তরে অন্তরে..’। গণমানুষের মানসপটে গেঁথে যাওয়া গানের কথাকে ব্যবহার করে সৃষ্টির ভিতের ওপরে নতুন সৃষ্টি, নিত্য নতুন অনেক সৃজনশীল কর্মের সঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাণের ঝোঁকও এখন বাড়ছে। বিজ্ঞ পরিচালক শিহাব শাহীন যেমন মিষ্টি একটি প্রেমকাহিনি নির্মাণ করে সবার মনের সুপ্ত ভালোবাসার আবেগ, অনুভূতিকে জাগিয়ে দিলেন। নির্মাতাদের অনুভূতির দর্শন প্রখর থাকে বলেই, গণমানুষের মনের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না বলা কথাও উৎসমুখ ভেদ করে বেরিয়ে আসে। এই চলচ্চিত্রটির মধ্যেও প্রেমের বিরহ কাতর যন্ত্রণাজাত ধড়ফড়ানি আছে।
‘হে আল্লাহ, তুমি কত দূরে’—আজকের কত সহজ যোগাযোগমাধ্যম ভিডিও কলে মুখোমুখি কথা বলা সত্ত্বেও দেশের মাটিতে বসে প্রেমিকা শারমিনের কণ্ঠে বিদেশে পড়তে যাওয়া তার প্রেমিক ফারহানের জন্য বারবার দীর্ঘশ্বাস আসে। শারমিন চরিত্রে অভিনয় করা তাসনিয়া ফারিণ ঘরে-বাইরে যুদ্ধে বারবার পর্যুদস্ত হয়ে আকুল নয়নে প্রেমিকের জন্য কেঁদে ভাসায়, আমাদের হৃদয়ের কোনায় কোনায় তোলপাড় হয়।
চলচ্চিত্রের বিচিত্র রং এবং দর্শকের মনের রং মিলেছে বলেই এই চিত্রকল্প, এই প্রেমের গল্প—অন্তিম মিলন সবার মন ছুঁয়ে গেছে।
শিহাব শাহীনের ‘বাবা, সামওয়ানস ফলোয়িং মি’ চলচ্চিত্রে বিদেশে পড়তে যাওয়া বিজু চরিত্রেও তাসনিয়া ফারিণকে আমরা দেখেছি। সেখানে বর্ণবৈষম্যের শিকার হওয়াতে যখন একজন সাদা চামড়ার মানুষ তার পিছু নিয়েছিল, আতঙ্কিত হয়ে দেশে থাকা বাবাকে সে ফোন দিয়েছে। এই চলচ্চিত্রে এসেও দেখলাম, অফিস ফেরত শারমিনকে অন্ধকার রাস্তায় ফারহানের পাশে এসে দাঁড়াতে। সে আতঙ্কিত, কারণ কেউ তাকে ফলো করছে। দুজনের পরিচয়ের প্রথম দৃশ্য থেকে মনে হতে পারে আবার একটা তীব্র আতঙ্কের বাতাবরণ, গভীর আশঙ্কার, উদ্বেগের ছবি তৈরি হতে যাচ্ছে। ছবির সঙ্গে ছবির যোগসূত্র রয়েছে। দুটি ছবিতেই একই নায়িকার একই রকমের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। যদিও এই ছবির পরিণতিতে সে রকম কিছু ঘটেনি। তাসনিয়া ফারিণের চরিত্র থেকে চরিত্রের এই উত্তরণ অসাধারণ লাগে।
মেয়েদের নিরাপত্তা দেশের মাটিতেই-বা কোথায়? দুষ্কৃতরা পিছু নিলে এখানেও শারমিনকে ব্যাগের ভেতর থেকে মরিচের গুঁড়া বার করে চোখে ছিটিয়ে দিয়ে পালাতে হয়। কলেজের অধ্যাপক জোর করে কাছে টেনে নিয়ে চুমু খায়, আর কেউ সেই দৃশ্য ভিডিও করে ভাইরাল করে দেয়। লোকলজ্জা, অপমান, অপবাদের ভয়ে মেয়ে এবং তার পরিবারকে এক শহর ছেড়ে অন্য শহরে চলে আসতে হয়। শারমিনের ব্যবসায়ী দাদা আবার বোনকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। বন্ধুর কাছ থেকে এই বলে বিপুল অঙ্কের অর্থ ঋণ নেয়, বোনের সঙ্গে তার বিয়ে দেবে। ঘরে–বাইরে লড়াই করা শারমিন এখন অন্দরসজ্জা, ইভেন্ট পরিচালনার কাজ করে। এখানেও বড় ইভেন্ট পরিচালনা করার জন্য ফোন আসে। কিন্তু কোম্পানির পরিচালক একজন নারী, তাই আমতা আমতা করে ফোন কেটে দেয়। নারীদের সর্বমুখী সামাজিক অবস্থানের চিত্র পরিচালক নিপুন মুনশিয়ানায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আবার গৃহ-অফিস অন্দরসজ্জার এই পেশাটা বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শিল্প মাধ্যমে এই শিল্পকর্মের পেশাটিকে তুলে এনে পরিচালক শিল্পের প্রতিও অন্য রকম একটা দায়বদ্ধতা পালন করলেন।
এই সবকিছুর পাশাপাশি মূল গল্পটা আসলে একটা সুন্দর মিষ্টি প্রেমের গল্প। চরিত্রের ভাঙাচোরা থেকে দুষ্টু মিষ্টি প্রেম, ফারিণ অসাধারণ অভিনয় দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলে সেরার সেরা অভিনেত্রী হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। তার প্রেমিক ফারহান চরিত্রে প্রীতম হাসানও অনন্য। এমন নরম কোমল মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের কাহিনির জন্য এমনই অভিনেতা দরকার।
ফারহান এতিম সন্তান। পড়াশোনায় যথেষ্ট মেধাবী। শিকড়হীন এই তরুণের সঙ্গে হঠাৎ জীবনে অন্ধকার নেমে আসা এক তরুণীর প্রেম। ছিন্নমূল মানুষের জীবনে প্রেম নিয়ে এসে পরিচালক প্রেমের মহত্ত্বকে আরও একবার নতুন করে ছড়িয়ে দিলেন। ফারহান শারমিনকে ডাকে এলাচি বেগম। বিরিয়ানি খাওয়ার সময় মুখে এলাচ পড়লে যেমন লাগে, শারমিনের মুখটা তার দৃষ্টিতে ঠিক তেমনি। আর শারমিন বৃষ্টিতে ছাতা ধার না দিয়ে ফারহানকে জ্বর এলে প্যারাসিটামল খেতে বলে। সত্যি সত্যি ফারহান জ্বরে কাবু হয়। অস্থির প্রেমিকা প্রেমিককে দেখতে না পেয়ে কখনো কলেজ চত্বর, কখনো ছাত্রাবাসে গিয়ে পর্যন্ত হানা দেয়। পরিবারের অমতে প্রেমটা পরিণতি পেতে পেতেও পায় না।
নিজের পায়ে দাঁড়াতে ফারহান উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশে চলে যায়। শারমিন তার প্রেরণা। প্রবাসের প্রতিটি মুহূর্তেও পাশে পাশে থাকে। দুজনের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি হয়। বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু পরিচালক বিচ্ছেদে নয়, যন্ত্রণা প্রদাহর নির্যাস অশ্রুকাতর মিলনে অন্তিম শূন্যতাকে ভরিয়ে দিয়ে যান। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শূন্য ক্ষতবিক্ষত জীবনের পরম আলিঙ্গনে প্রেমের পূর্ণতা এনে দেন।
সুন্দর চিত্রনাট্য। অনবদ্য চিত্রায়ণ। সুর আর স্বরের সংলাপে টান টান এক মরমিয়া তীব্র আবেগপ্রবণ প্রেমের সফর। ‘কাছের মানুষ দূরে রেখে আমি ঢেউ গুনি একা কূলে..’ চলচ্চিত্রের ঘটনার সঙ্গে সংগত রেখে গানটি ভালো লাগে। নরম কোমল কথা, সুরের মতো গানের চিত্রায়ণও চমৎকার। তবে কাহিনি এত আবেগপ্রবণ এবং উচ্চমানের সুর আর কথার বাঁধুনিতে আরও ভালো গান আসার প্রয়োজন ছিল। চলচ্চিত্রের নাম যেহেতু কালজয়ী একটি গানের অংশ, সাহসী বর্তমানকে অতীতকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা রাখতে হবে। রাজশাহী থেকে অস্ট্রেলিয়া—পরিচালক সুন্দরের দৃশ্য ধারণে, বুনোনে ত্রুটি রাখেননি। আজকের ভুবন গ্রামের বাঙালিরাও এমনই চলচ্চিত্র বারবার দেখতে প্রত্যাশী। চলচ্চিত্রের বিচিত্র রং এবং দর্শকের মনের রং মিলেছে বলেই এই চিত্রকল্প, এই প্রেমের গল্প—অন্তিম মিলন সবার মন ছুঁয়ে গেছে।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত