অনভিপ্রেত ঘটনার ‘ছুটির ঘণ্টা’ এবং শৈশব

‘ছুটির ঘণ্টা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যছবি: ইউটিউব থেকে

‘ছুটির ঘণ্টা’ আমাদের ছোটবেলার ছবি। আমার জন্মের বছরে ১৯৮০ সালে এটি মুক্তি পেয়েছে। ছবিটা দেখেছি অনেক পরে। মায়ের মুখে ছবির গল্প তত দিনে শোনা হয়ে গেছে। ছোটবেলার হইচই, স্কুলজীবন, পড়াশোনা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক উৎসব—সব মিলিয়ে ছবিটা যতটা আনন্দের, তার চেয়ে বেশি আতঙ্কের, ভয়ের, চরম উৎকণ্ঠার। মায়ের মুখে ছোট্ট খোকনের পরিণতির কথা শুনে রাতে ঘুম আসত না। খোকনের জন্য মনে মনে কতবার যে কেঁদেছি।

ছেলেধরা নিয়ে এমনিতেই আমাদের একটা আতঙ্ক ছিল। মা বলত, দেশের যেখানে যত ব্রিজ তৈরি হয়, ছেলেধরা লোক এসে ছোট ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে সেখানে বলি দেয়। মানবশিশুর বলির রক্ত না পেলে নাকি ব্রিজ জোড়া লাগে না। পরবর্তী সময়ে বুঝতে পেরেছি, এগুলো আসলে আজগুবি সব গল্প। ছেলেধরা সম্পর্কে ছোটবেলায় আমাদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্য এসব আজগুবি গল্পের অবতারণা। কারণ, বাস্তবেই তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশে ছেলেধরা নামের একটা আতঙ্ক ছিল। অভিভাবকেরা সন্তানকে সেই রাহুগ্রাস থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন।

একবার বাসে করে শহর থেকে রাউজান উত্তরগুজরা গ্রামে যাওয়ার সময় ভিড় বাসে এক ব্যক্তি আমাকে ধীরে ধীরে হাত ধরে টেনে গেটের কাছে নিয়ে আসে। গন্তব্যস্থলে নামবে বলে মা–বাবাও পেছন পেছন আসছিল। কিন্তু বাস থেকে নামিয়ে ওই ব্যক্তি আমাকে নিজের পেছনে দাঁড় করিয়ে রাখে। মা–বাবার হঠাৎ নজরে পড়ামাত্র চিৎকার–চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। বাসের কন্ডাক্টর থেকে চালক, যাত্রীসহ সবার নজর এসে পড়ে। আর সেই ব্যক্তি বলতে থাকে, সে আমাকে নামতে সাহায্য করছিল শুধু। তৎক্ষণাৎ হাত ধরে আমাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। মুহূর্তের গোটা ঘটনায় একপ্রকার বোকা বনে গিয়েছিলাম।

সেই প্রথম ছেলেধরা দেখতে কেমন হয়, একটা ধারণা জন্মাল। যেভাবে পাথরঘাটার বাসার নিচের তলায় যে শুঁটকি বিক্রেতা পরিবারটি থাকত, একদিন দেখলাম এক চোরকে ঘরের ভেতরে চেয়ারে বেঁধে সবাই মিলে মারছে। সেই চোর রোজ বাইরে শুকাতে দেওয়া কাপড় চুরি করে নিয়ে পালাত। এই ছেলেধরা বা চোর—ওরাও যে রক্তমাংসের মানুষ, ভূতপ্রেতের মতো অশরীরী কিছু নয়, এই প্রথম বুঝতে শিখলাম।

কিংবদন্তি পরিচালক আজিজুর রহমান শিশুদের কল্পনা, মনোজগৎ, শৈশবের সুন্দর দিন এবং তার সঙ্গে একটা বড় দুর্ঘটনা, অনভিপ্রেত মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের ইতিহাস বহনকারী চিরকালের একটা শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে রেখে গেলেন। এই চলচ্চিত্রের আবেদন আজও প্রাসঙ্গিক। স্কুল ছুটির পর থেকে খোকনকে যখন পাওয়া যাচ্ছে না বলে, এখানেও ছেলেধরার প্রসঙ্গ এসেছে।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে চলচ্চিত্রের গানের অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে এই ছবির বিখ্যাত দুটি গান ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’ ও ‘একদিন ছুটি হবে’ দেখানো হতো। ‘স্বপ্নপুরী’ গানটার চলচ্চিত্রায়ণে শিশুপার্কের দৃশ্য এবং খোকন মানে আসাদুজ্জামান খোকন চরিত্রটির অভিনেতা মাস্টার সুমনের সঙ্গে বাস্তবের জাদুকর জুয়েল আইচও আছেন। শিশুদের মনোজগৎ জাদুর নেশায়, জাদুর টানে কল্পনার জগতে ভেসে বেড়ায়। পরিচালক কল্পনার চলচ্চিত্রজগতের মধ্যে বাস্তবের জাদুকরকে নিয়ে এসে বাস্তবকে যেন আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন। প্রকৃতই এ এক অভিনব, অনবদ্য সৃষ্টি। যদিও জাদুবিদ্যাও একপ্রকার কৌশল। কিন্তু এত সুন্দর এবং মধুর গানটিও যখন বিটিভিতে দেখানো হতো, বুকের ভেতরে কেমন ঢিপ ঢিপ করত। খোকনের পরিণতির কথা ভেবে এ গানটিও উপভোগ করতে পারতাম না। ঠিক যেভাবে ‘একদিন ছুটি হবে’ শিশুমনের ওড়াল দেওয়ার গান। এই গানে মনের উড়ালপঙ্খীর ডানা মেলে বড়রাও যখন আজ আনন্দে ভেসে যেতে পারে, আমি পারি না।

ছুটি আনন্দের বিষয়। ছোট–বড় সবাই জীবনে একটু বিশ্রাম, পরিসর ছুটি চায়। কিন্তু যে চলচ্চিত্রে ব্যবহারের মাধ্যমে এই গানের এত জনপ্রিয়তা, সেই ‘ছুটির ঘণ্টা’ একেবারে জীবন থেকে ছুটি হয়ে যাওয়ার ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে যায়। মৃত্যু জীবনের একটা প্রকৃত সত্য। এই সত্যের মুখোমুখি সবাইকে একদিন হতে হয়। সেই সত্য যদি অকালে, অনভিপ্রেত কোনো ঘটনার মাধ্যমে হঠাৎ এসে দাঁড়ায়, এই দুঃখভার বহন অসহনীয় হয়ে যায়। চলচ্চিত্রের শুরুতে তাই লেখা থাকে ‘একটি ঘটনা, ঘটনা নয় দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনা-দুর্বিপাক নিয়েই আমাদের জীবন। তবে একটু সতর্ক, একটু কর্তব্য সচেতন হলে আমরা হয়তো অনেক দুর্ঘটনা এড়াতে পারি। খোকনের মতো লাখ লাখ শিশুর দুর্ঘটনা-মুক্ত দীর্ঘ জীবনের প্রত্যাশায় আমাদের নিবেদন “ছুটির ঘণ্টা”।’

এই চলচ্চিত্রের আতঙ্ক আমাদের তাড়িয়ে বেড়াত বলেই, জে এম সেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ার সময় ছুটির পর কখনো একলা স্কুলের টয়লেটে যেতাম না। আমাদের পায়খানা-প্রস্রাবখানার মূল দরজাও ছিল একটা। বন্ধুর যদি প্রস্রাব না–ও পায়, তবু আমি তাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতাম। মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলে যাওয়ার পরে এই আতঙ্ক অবশ্য ছিল না। কারণ, স্কুলের বাথরুম থেকে অনেক দিকে বের হওয়ার পথ ছিল। লম্বা খোলা বারান্দা রাস্তা থেকেও দেখা যায়। আবার স্কুলের ভেতরেই দপ্তরি, দারোয়ানসহ অনেক কর্মী থাকেন। ফলে ছুটির পর কেউ এভাবে আমাকে তালাবন্দী করে একলা ফেলে রেখে চলে যেতে পারবে না। একটি চলচ্চিত্র তীব্র ভয়, চরম আতঙ্ক থেকে এভাবেই আমাদের একপ্রকার সচেতনও করে তুলেছিল।

আজিজুর রহমানের চিত্রনাট্য, পরিচালনায় এই চলচ্চিত্রের শৈল্পিক, কারিগরি প্রতিটি দিকও বেশ সুন্দর। দপ্তরি আব্বাস মিয়ার চরিত্রে রাজ্জাক অসাধারণ। আব্বাস মিয়া খোকনকে এত ভালোবাসত, তা সত্ত্বেও তারই অসাবধানতার, সামান্য ভুলের জন্য খোকনকে চিরতরে হারিয়ে যেতে হয়। তার এই অনুতাপ, পরিতাপ জেলবন্দী উন্মাদ হয়ে যাওয়া জীবন রাজ্জাক অনবদ্য রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন। খোকনের জন্য দুঃখের পাশে আব্বাস মিয়ার অনুশোচনাও আমাদের দগ্ধ করে। রাজ্জাক মিয়ার জেলবন্দী জীবনের সঙ্গে খোকনের ১২ দিন বাথরুম–বন্দী জীবনের একটা সাদৃশ্য পরিচালক তুলে আনেন। ছোটবেলায় আমাদের সবারই একলা থাকতে ভয় হয়। এ ভয় থেকেই যত রাজ্যের ভূতপ্রেতের উৎপত্তি। পরিচালক সেই ভয়কে বাস্তবের আতঙ্কে পরিণত করেছেন। খোকন চরিত্রে মাস্টার সুমন তাঁর অভিনয়ের অল্প বয়সেই কালজয়ী অভিনেতায় পরিণত হয়েছেন।

বাথরুমের দেয়ালে নিজের যন্ত্রণা, কষ্ট, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধের কথা লিখে যাওয়া আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির কথা মনে করিয়ে দেয়। আবার ভয় বা আতঙ্কের বাইরে এসে পরিচালক আসলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত খোকনের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মাধ্যমে ছোটদেরও একপ্রকার বড় জীবনযোদ্ধা বানিয়ে দিয়েছেন। যুদ্ধে হার–জিত, জীবন–মৃত্যু থাকে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই একজন মানুষকে মরার পরেও অমর করে দিয়ে যায়।

চলচ্চিত্রে আরও অভিনয় করেছেন শাবানা, সুজাতা, শওকত আকবর, এ টি এম শামসুজ্জামান, ফজলুর রহমান, কায়েস, ডা. অরূপ রতন চৌধুরী, পঙ্কজ বৈদ্য, আখতার হোসেন, রবিউল, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, বিকাশ, পরাণ বিশ্বাস, পুলিন মিত্র, ওয়াহিদা রহমান, সুষমা, শর্বরী, বেবী, ডলি, নারায়ণ চক্রবর্তী, জাহাঙ্গীর হুদা, সিরাজুল ইসলাম মন্টু, বুলবুল ওয়াজেদ, নজরুল, আওয়াল, আখতার, মাস্টার রানা, রবার্ট, পিকলু, কল্লোল, মাস্টার টয়, মিল্টন ও একদল ছাত্র। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমীন, খন্দকার ফারুক আহমেদ, আবিদা সুলতানা, শাম্মী আখতার। যন্ত্রসংগীতে ছিল আলাউদ্দিন লিটল অর্কেস্ট্রা। শিল্প নির্দেশনায় ছিলেন আবদুস সবুর, স্থিরচিত্র গ্রাহক নজরুল ইসলাম নুটু, চিত্রগ্রাহক বুলবুল ওয়াজেদ, চিত্রগ্রহণ পরিচালনা করেছেন সাধন রায়, কাহিনি গীত ও সংলাপ রচনা করেছেন মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, সহযোগী পরিচালক ছিলেন মতিন রহমান, সম্পাদনা করেছেন নুরুন নবী এবং সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন সত্য সাহা।

কোনো দেশের কোনো স্কুলে যেন এ ধরনের কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা না ঘটে, কোনো শৈশব-কৈশোরকে যেন অকালে হারিয়ে যেতে না হয়, শৈশবে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার আতঙ্কের ছাপ নিয়ে গোটা জীবন কাটাতে না হয়—এ চলচ্চিত্র সেই বার্তা দিয়ে যায়।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত