মানুষকে অধ্যয়ন করে যে বিজ্ঞান

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের একদল শিক্ষার্থীছবি: লেখকের সৌজন্যে

প্রায় ৪৫৪ কোটি বছর আগে সৃষ্টি হওয়া পৃথিবী নামক সবুজ গ্রহটিতে যে প্রাণীটির সর্বত্র বিস্তার, সে হলো মানুষ। এই মানুষের হাত ধরে পৃথিবীতে কত পরিবর্তন-পরিবর্ধন সাধিত হচ্ছে, হয়েছে তা আমরা সবাই জানি। আর এই মানুষকে নিয়ে অধ্যয়ন করে বিজ্ঞানের যে শাখা, তা হলো নৃবিজ্ঞান।

অর্থাৎ মানুষের অতীত ও বর্তমানের সঙ্গে সম্পর্কিত সব বিষয়ের বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ নৃবিজ্ঞান। ইতিহাস, সংস্কৃতি, জলবায়ু, দুর্যোগ, রোগতত্ত্ব, আইন, পাবলিক পলিসি, ব্যবসা, উন্নয়ন—এমন নানা বিষয় নৃবিজ্ঞানে আলোচনা করা হয়।

নৃবিজ্ঞানের ইতিহাস
আধুনিক নৃবিজ্ঞানের জন্ম উনবিংশ শতাব্দীতে হলেও এর উৎপত্তির ইতিহাস বেশ পুরোনো। গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাস থেকে এরিস্টটল এবং ভ্রমণকারী ও যুদ্ধজয়ী রাষ্ট্রনায়কেরা জাতিতাত্ত্বিক বিবরণীর মাধ্যমে এ বিজ্ঞানের বিস্তার ঘটান। এমনকি নৃবিজ্ঞানের ইংরেজী শব্দ (Anthropology) দার্শনিক এরিস্টটল কর্তৃক প্রদত্ত বলে জানা যায়। যার অর্থ মানুষের বিজ্ঞান। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নৃবিজ্ঞানের পথচলার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিকদের প্রয়োজন এবং ইউরোপের রেনেসাঁ ও আলোকময়তা সব চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। এভাবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো তাদের শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীর বিবরণ সংগ্রহ করতে থাকেন নৃবিজ্ঞানীদের সহযোগিতায়। শুরুর দিকে নৃবিজ্ঞান ঔপনিবেশিকদের সহযোগিতা করলেও পরবর্তীতে তাদের আসল মুখোশ উন্মোচনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

সাম্প্রতিক নৃবিজ্ঞান
বর্তমানে নৃবিজ্ঞানের কার্যক্রম অনেক বেশি বিস্তৃত। নৃবিজ্ঞান তার জাতিতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমান আধুনিক ও উত্তরাধুনিক যুগে মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নানা সমস্যা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়াও মহামারি, নতুন নতুন রোগের উৎপত্তি ও সংক্রমণ রোধেও কাজ করছে। যার প্রমাণ ২০২২ সালে চিকিৎসায় নোবেল পাওয়া বিজ্ঞানী সভান্তে প্যাবো। যিনি তাঁর গবেষণায় দেখান কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের (হোমো সেপিয়েন্স) মধ্যে যাদের সঙ্গে নিয়ানডার্থালদের জিন সিকোয়েন্সের সবচেয়ে মিল আছে, তারা বেশি আক্রান্ত হয়েছে। আর যাদের মিল কম তাঁরা অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত হয়েছে। এর বাইরে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির রেসিডেন্স এক্সপ্লোরার জাহি হাওয়াস থেকে শুরু করে অগনিত নৃবিজ্ঞানী রয়েছেন, যাঁরা বর্তমানে বিজ্ঞানের এই শাখাটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

বাংলাদেশে যেভাবে শুরু নৃবিজ্ঞানের পথচলা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক হাসান শাফি ও সাইফুর রাশিদের একটি গবেষণাপত্র হতে জানা যায়, বাংলাদেশে ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নৃবিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা হয়। প্রাথমিকভাবে যা নৃবিজ্ঞানের পড়াশোনা সম্পর্কিত সংগঠন করার জন্য একটি ফোরাম হিসেবে কাজ করেছে। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস) নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণার পাশাপাশি বিষয়টির বিকাশে সহায়তা করে।

বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে নৃবিজ্ঞানের পথচলা শুরু হয় ১৯৮৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর পর্যায়ক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯২), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৬), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৫), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৮/৯৯), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (২০০৮), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (২০০৯) ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর চালু করা হয়।

নৃবিজ্ঞান
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

একই সময়ে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও নৃবিজ্ঞানকে পৃথক বিভাগ হিসেবে বা অন্যান্য বিজ্ঞানের কোর্স হিসেবে যুক্ত করে। যেমন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি, আশা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশসহ শেখ বোরহানউদ্দিন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজে স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে নৃবিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছে।

বিদেশে উচ্চশিক্ষা
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বড় সুযোগ রয়েছে এ বিভাগে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য। বিগত একশ বছর, বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বিশ্বব্যাপী বহুল চর্চিত একটি বিষয় হচ্ছে নৃবিজ্ঞান। সামাজিক বিজ্ঞান পড়ানো হয় বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে থাকা এমন প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই নৃবিজ্ঞান রয়েছে। এমনকি স্কলারশিপের পরিমাণ হিসেব করলেও নৃবিজ্ঞান প্রথম সারিতেই থাকবে। এর মধ্যে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, টরন্টো ইউনিভার্সিটি, আপসালা ইউনিভার্সিটি, হেলসিংকি ইউনিভার্সিটি উল্লেখযোগ্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নৃবিজ্ঞানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করার সুযোগ রয়েছে।

নৃবিজ্ঞানে যা পড়ানো হয়
পূর্বেই বলা হয়েছে, মানুষ সম্পর্কিত সবকিছু নৃবিজ্ঞানে পড়ানো হয়। তবে নৃবিজ্ঞানের চারটি প্রধান শাখা রয়েছে—যথাক্রমে দৈহিক নৃবিজ্ঞান, সামাজিক/সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান ও ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান।

দৈহিক নৃবিজ্ঞান: দৈহিক নৃবিজ্ঞান সময়ের সঙ্গে মানুষের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনকে অধ্যয়ন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে জেনেটিক্স, বিবর্তন, প্রাচীন মানুষ, প্রাইমেট এবং তাদের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়াতে জোর দিয়ে থাকে। এর ফলে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে যেমন ধারণা পাই, তেমনি শারীরবৃত্তীয় নানা রোগের উৎপত্তির কারণ ও বিস্তার রোধের উপায় খুঁজে পাই।

সামাজিক/সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান: সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের কার্যক্রম এক হলেও ব্রিটিশ ও আমেরিকান নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে শব্দগত ব্যবহারের পার্থক্য পরিলক্ষিত। তবে পার্থক্য আর যা–ই থাকুক না কেন, নৃবিজ্ঞানের এই শাখায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সামাজিক সংগঠন এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে তুলনামূলকভাবে পর্যালোচনা করা হয়।

প্রত্নতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান: প্রত্নতত্ত্ব একটি স্বতন্ত্র জ্ঞান কাণ্ড হলেও আমেরিকান নৃবিজ্ঞানীরা এটিকে নৃবিজ্ঞানের শাখা হিসেবে মনে করেন। প্রত্নতত্ত্ব মূলত আধুনিক ও প্রাচীন মানুষের সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের ধারা বর্ণনা করে। যার ফলে আমরা মানুষ ও মানুষ বর্গীয় প্রাইমেটদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে পরিবর্তন হয়েছে, তা জানতে পারি। বিভিন্ন প্রাণীর ফসিলের বয়স জানতে পারি।

ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞান: পৃথিবীতে সাত হাজারেরও অধিক ভাষা রয়েছে; যা প্রতিনিয়ত যেমন বিলুপ্ত হচ্ছে, তেমনিভাবে ভাষার ধরনেরও পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, পৃথিবীতে সৃষ্টির শুরুতে তো এত ভাষা ছিল না? তাহলে মানুষ সৃষ্টির তিন লক্ষ বছরের ব্যবধানে কীভাবে এত ভাষার উৎপত্তি হলো? ভাষা কেনই বা পরিবর্তিত হয়? ভাষার প্রয়োজনীয়তাই বা কি? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানীরা। কেননা ভাষা হলো মানুষের প্রাণ। ভাষা ছাড়া মানুষের মতপ্রকাশ কিংবা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া—সব কিছুই বৃথা। এই ভাষার জন্যই মানুষ জীব হিসেবে অনন্য।

নৃবিজ্ঞানীদের কর্মক্ষেত্র
নৃবিজ্ঞানে রয়েছে বিস্তৃত আলোচনার জায়গা, কাজ করার সুযোগ। যেহেতু প্রতিটি জায়গা বা প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রই মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাই এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে অ্যানথ্রোপোলজিস্ট কাজ করতে পারেন না। বর্তমানে দেশি-বিদেশি এনজিও এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই বিভাগের চাকরির ক্ষেত্র রয়েছে। শুধু চাকরির ক্ষেত্র বললে ভুল হবে, বেশকিছু খ্যাতিসম্পন্ন সংস্থায় নৃবিজ্ঞানের প্রচুর শিক্ষার্থীরা কাজ করছে। যেমন ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন, ফাও, ওয়ার্ল্ড ফিশ, ইকো ফিশ, ব্র্যাক, আইসিডিডিআরবি, সেভ দ্য চিলড্রেন, নেলসনের কথা বলা যেতে পারে। এ ছাড়াও দেশের করপোরেট চাকরিবাজারে (ব্যাংক, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি) প্রবেশ করার সুযোগও আছে এই বিভাগ থেকে।

এর বাইরেও জাদুঘরের কিউরেটর, ফরেনসিক ল্যাব ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিশেষজ্ঞের ভূমিকা পালন করতে পারে নৃবিজ্ঞান। বর্তমানে চলচ্চিত্র অঙ্গনেও কাজ করছেন নৃবিজ্ঞানীরা। ‘অ্যাভাটার’ মুভিটিতে যে কালচার দেখানো হয়েছে, সেই অ্যানালাইসিসের কাজ এবং ছবিতে যে না’ভি ভাষা ব্যবহার করা হয়, সেখানেও নেতৃত্ব দেন ভাষাতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানী ড. পউল ফ্রম্মার। এগুলো ছাড়াও সরকারি চাকরি ও গবেষণা খাত নৃবিজ্ঞানীদের জন্য উন্মুক্ত।

বাংলাদেশের উন্নয়নে যেভাবে ভূমিকা রাখতে পারে নৃবিজ্ঞান
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ (৬টি ক্ষুদ্র দ্বীপ ও নগররাষ্ট্র বাদ দিয়ে)। তাই দেশটিতে সামাজিক-আর্থসামাজিক ও মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে সামগ্রিক উন্নয়নের প্রশ্ন এলে প্রায়ই রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। এখনো এদেশের প্রান্তিক অঞ্চলের গোষ্ঠীগুলো বিশেষ করে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, ট্রান্সজেন্ডার, দলিত, পিইজেন্ট (ক্ষুদ্র কৃষক) ও প্রতিবন্ধীরা নানাভাবে বঞ্চিত। কিন্তু একটি রাষ্ট্রকে ‘উন্নত’ কিংবা সমৃদ্ধ দেশের আসনে বসাতে চাইলে রাষ্ট্রের সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নৃবিজ্ঞানের গ্রাজুয়েটরা বছরজুড়ে রাষ্ট্রের পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বিস্তরভাবে পড়াশোনা করেন। তাই রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই নৃবিজ্ঞানের জ্ঞান রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়নে ভিত্তি এনে দেবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, তা বাস্তবায়ন ও নিরীক্ষণে নৃবিজ্ঞানীরা কাজ করতে পারে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসান শাফি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত দেশে সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্ন থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রে নৃবিজ্ঞানীদের প্রয়োজন থাকবে।

দপ্তর সম্পাদক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা