মসজিদ আগের চেয়ে ঢের বড় হয়েছে। কিন্তু রাত জেগে মানুষ ইবাদত করে না, বারান্দায় শিরনি-তবারকের স্তূপ হয় না। বাচ্চারা আনন্দে হৈ-হুল্লোড় করে না।
আজ থেকে বছর কয়েক আগেও আমাদের ঈদ উৎসবের দিনগুলোর একটি ছিল শবে বরাত। আহা, কী আনন্দমুখর ছিল সেসব দিন! কখনো কখনো ঈদ আনন্দকেও ছাপিয়ে যেত সেই আনন্দ। বাড়িতে বাড়িতে বেশ আগে থেকে শুরু হতো শবে বরাতের প্রস্তুতি। কাপড় ধোয়া, ঘরদোর পরিষ্কার করা, রকমারি রান্না আর ভালো-মন্দ খাওয়ার পরিকল্পনা, আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করাসহ আরও কত কী!
শবে বরাতের দিন কাকডাকা ভোরে ঢেঁকির শব্দে ঘুম ভাঙত। ইতিউতি থেকে আসা ঢেঁকির শব্দে গমগম করত সারা পাড়া। দিনের প্রথম প্রহর থেকে শুরু হয়ে যেত উৎসবের আমেজ। গরু জবাই হতো পাড়ায় পাড়ায়। পাড়ার লোকেরা সেখান থেকে মাংস সংগ্রহ করত। অবশ্য এর জন্য কয়েক দিন আগেই টাকা জমা দিয়ে নাম লেখাতে হতো খাতায়। যাঁরা এই মাংসের ভাগ পেতেন না, তাঁরা স্থানীয় বাজার থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে মাংস সংগ্রহ করতেন।
মুরগির দোকানগুলোতেও থাকত উপচে পড়া ভিড়। দিনের দ্বিতীয় প্রহরে বিক্রি হয়ে যেত সব মুরগি। দুধের বাজারে মানুষের আনাগোনা থাকত সমানতালে। একই চিত্র চোখে পড়ত মুদিদোকানগুলোতেও। সেদিন সাধারণ দিনের চেয়ে কিছুটা বাড়তি মূল্যে বিক্রি হতো জিনিসপত্র। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে বাড়তি দামে সব বাজার শেষে মানুষের মুখে থাকত পর্বতজয়ের হাসি।
ওদিকে ঢেঁকিঘর, রসুইঘরেও দিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ত ব্যস্ততা। ভেজা আতপ চালভর্তি গামলার সারি নিয়ে বসে থাকতেন পাড়ার বউ-ঝিরা। বিকেল পর্যন্ত চলত ঢেঁকির দাপুরদুপুর শব্দ। চাল গুঁড়া করে যে যার বাড়ি গিয়ে রুটি বানানো শুরু করে দিতেন। রসুইঘরের একপাশে চলত রুটি বেলা ও সেঁকার কাজ, অন্য পাশে হাঁড়িতে চড়ত মাংস আর দুধ-সুজির হালুয়া।
বেলা গড়িয়ে এলে দলে দলে সাহায্যপ্রার্থীরা আসতেন রুটি, চালের গুঁড়া, আটার খামির এসব সংগ্রহ করতে। প্রত্যেক বাড়ির কর্ত্রী নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের হাতে খাবার তুলে দিতেন। কাউকে খালি হাতে ফেরাতেন না।
সন্ধ্যা নামতে শুরু করলে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা হাতের কাজ সেরে ঘরে ফিরতেন। মাগরিবের নামাজের পর গোসল করে প্রস্তুতি নিতেন এশার নামাজের জন্য। আমরা বাচ্চারাও বড়দের সঙ্গে গোসল করে মসজিদমুখী হতাম। সাধারণ দিনের চেয়ে সেদিন মসজিদের চিত্র থাকত একেবারে ভিন্ন। পুরো মসজিদ কানায় কানায় পূর্ণ থাকত ছেলেবুড়োতে। চট বিছিয়ে দেওয়া হতো মসজিদের মাঠে। সেখানেও মুসল্লিদের ভিড় থাকত চোখে পড়ার মতো।
মসজিদের বারান্দার একটা কোণ বরাদ্দ থাকত শিরনি-তবারক রাখার জন্য। পাড়ার বাড়িগুলো থেকে আসা হালুয়া, রুটি, চমচম, দানাদার, বাতাসা আর বিস্কুটের স্তূপ হতো সেখানে। গোলাপজল, আতর ও খাবারের গন্ধ মিলে অন্য রকম এক সুগন্ধ ছড়িয়ে যেত মসজিদের ভেতর-বাইরে। এ যেন উৎসবের ঘ্রাণ, যা অনেক দিন পর্যন্ত লেগে থাকত আমাদের নাকে।
প্রথম প্রহরের নামাজ শেষে ইমাম সাহেবের সঙ্গে সবাই স্থানীয় করবস্থানে যেতাম। সেখানে মৃত ব্যক্তিদের আত্মার উদ্দেশে সম্মিলিত দোয়া হতো। প্রত্যেকে নিজ নিজ হারানো মানুষদের কথা স্মরণ করে দোয়ার মধ্যে ডুকরে কেঁদে উঠতেন।
দোয়া শেষে আবার মসজিদে ফিরতেন সবাই। এরপর বেশ সময় ধরে চলত জিকির-আসগার, দরুদ পাঠ ও আখেরি মোনাজাত। মোনাজাত শেষে শিরনি-তবারক বিতরণ করা হতো। সব মুসল্লিকে দেওয়ার পরেও অনেক খাবার থেকে যেত মসজিদের বারান্দায়। রাতের মুসল্লিদের জন্য সেগুলো গুছিয়ে রাখা হতো।
মানুষের মধ্যে এ দিনটি নিয়ে আর কোনো ব্যস্ততা নেই। এখন আর ঢেঁকির শব্দে ঘুম ভাঙে না, পাড়ায় গরু জবাই হয় না, বাজারের দোকানগুলোতে ভিড় জমে না।
আমরা শিরনি-তবারক নিয়ে বাড়ি ফিরে গরম গরম মাংস-রুটি খেতাম। আত্মীয়রা আসতেন বাসায়, আমরাও যেতাম আত্মীয়দের বাসায়। রাত যত গভীর হতো, পুরো পাড়া যেন উৎসবে মেতে উঠত। খাওয়া ও বেড়ানো শেষে আবার মসজিদে জড়ো হতাম। সারা রাত মসজিদ খোলা থাকত। মুসল্লিরা ইবাদতে মশগুল থেকে রাত ভোর করতেন। আমরা বাচ্চারাও তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত ও তসবিহ পাঠ করতাম।
ঘুম পেলে দলবেঁধে স্থানীয় খেলার মাঠে গিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতা দিতাম। আকাশ থেকে ঠিকরে পড়ত বাঁধভাঙা চাঁদের আলো। সেই আলো গায়ে মেখে হারিয়ে যেতাম রূপকথার দেশে। কী সুন্দর ছিল সেই রাতটি! সেই দৃশ্য আজও চোখের আয়নায় ভেসে ওঠে।
ছুটোছুটিতে ক্লান্ত হয়ে মসজিদে ফিরতাম। বেঁচে যাওয়া শিরনি-তবারক খেয়ে ছুটতাম অন্যান্য মসজিদের দিকে। চেষ্টা থাকত আশপাশের পাড়ার সব মসজিদে ২ রাকাত করে হলেও নামাজ আদায় করা। এরপর নিজ পাড়ার মসজিদে ফজরের নামাজ শেষে, বাড়ি ফিরে দিতাম লম্বা ঘুম।
ঘুম থেকে উঠে সবার মধ্যে চলত ইবাদত বন্দেগির হিসাব-নিকাশ। কে কত রাকাত নামাজ আদায় করেছে, কত পারা কুরআন তিলাওয়াত করেছে, কতবার তসবিহ পাঠ করেছে এসব। যার ইবাদতের পাল্লা ভারী হতো, তার ভাবই থাকত আলাদা। বেশ কিছুদিন সে এই ভাবখানা ধরে রাখত। অন্যরা মনে মনে পণ করত, আগামী শবে বরাতে তার চেয়ে বেশি ইবাদত কেউ করতে পারবে না।
ইশ, কী সুন্দর দিন ফেলে এসেছি! এখন আর এসব দেখা যায় না। চোখের সামনে দিয়ে কীভাবে আমূল পাল্টে গেল একটি উৎসবমুখর দিন। আধুনিকতা আর বিদাত এসে গিলে খেল সব। শবে বরাত এখন বছরের অন্য পাঁচটা সাধারণ দিনের মতোই একটি দিন। এ ছাড়া আর বিশেষ কিছু লক্ষ করা যায় না।
মানুষের মধ্যে এ দিনটি নিয়ে আর কোনো ব্যস্ততা নেই। এখন আর ঢেঁকির শব্দে ঘুম ভাঙে না, পাড়ায় গরু জবাই হয় না, বাজারের দোকানগুলোতে ভিড় জমে না। মসজিদ আগের চেয়ে ঢের বড় হয়েছে। কিন্তু রাত জেগে মানুষ ইবাদত করে না, বারান্দায় শিরনি-তবারকের স্তূপ হয় না। বাচ্চারা আনন্দে হৈ-হুল্লোড় করে না। যে রাতে ছেলে–বুড়ো সবাই উৎসবের কুপি জ্বেলে জেগে থাকত, সে রাত এখন ঘুমিয়ে ভোর হয়ে যায়।
বনশ্রী, ঢাকা