কলমি ফুলের দিনগুলো

খালের পাশ থেকে মনের আনন্দে কলমি ফুল তুলছে এক শিশু। ছবিটি ফরিদপুর সদরের খিদিরবিশ্বাসের ডাঙ্গী এলাকা থেকে তোলা। প্রতীকীছবি: আলীমুজ্জামান

জোয়ারের পানিতে ভরে গেছে চারপাশ। খাল-বিল পূর্ণ হয়ে বাড়ির উঠানেও কোমর অবধি পানি। মুষলধারে বৃষ্টির ক্ষান্ত হওয়ার নাম নেই। একমনে তাকিয়ে আছি বিলের দিকে। একজন কিশোর বাঁশ বা কাঠের টুকরা দিয়ে ভেলা ভাসিয়েছে। বৃষ্টিতে তার মোটেও অসুবিধা হচ্ছে না। ভেলার সামনে রাখা কয়েক মুঠো শাপলা। তাকিয়ে আছি ওর দিকে, কিন্তু যেতে পারছি না। মায়ের বারণ।

সেদিনের ভেলা ভাসানো ছেলেটাকে দেখে যতটা মুগ্ধ হয়েছি, সে রকম মুগ্ধ আর হই না বহুকাল। আমরা নদীমাতৃক এলাকার মানুষ। বর্ষা এলেই চারদিকে পানিতে টইটম্বুর। চর, বন্যা আর নদীর ভাঙন যেন জীবনের নিত্য অনুষঙ্গ।

ছোটবেলায় আমাদের রসুইঘরের চালজুড়ে ছড়িয়ে থাকত শিমগাছ। শিমের কয়েক রকম নামও ছিল এলাকায়। মাঝেমধ্যেই দেখা যেত, সেখানে বাসা বেঁধেছে ঘুঘু পাখির দল। খুব সাবধানে দেখতে হতো। প্রচলিত ছিল, অনেক চোখ দেখলে তারা সেখানে আর থাকে না।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, রসুইঘরটা সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। গাছপালাও ভাঙা। মন খারাপ হয়েছিল খুব। ছোট ঘুঘু পাখিগুলো কি বেঁচে আছে? থাকলে এখন ওরা কোথায় থাকবে?

ঘন বর্ষায় মেঘেদের লুকোচুরিতে সূর্যের আলোয় চিকচিক করত একেকটা কলমির ফুল। বিলের ধারে কলমিলতার ছড়াছড়ি। পানির রাজ্যে তারা একচ্ছত্র অধিপতি। আমরা ফুলগুলো তুলে আনতাম। তুলতুলে কোমল, মোলায়েম। ছিঁড়ে আনার একটু পরেই শুকিয়ে যেত। তবু ছিঁড়তে হবে। কলমিলতার দুপুর, সন্ধ্যা আর স্নিগ্ধ সকালের মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খাওয়া এখন যেন স্বপ্নের মতো। সচরাচর চোখেও পড়ে না খুব একটা।

মানুষ স্মৃতি জিইয়ে রাখে। পরম যত্নে আগলে রাখে মস্তিষ্কে। জানে ফিরে আসবে না কোনো দিন। হাসি, কান্না আর একবুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তবু স্মরণ করে বারবার।

রাস্তার দুই ধারে থইথই পানির মধ্যে মাথা উঁচু করে থাকত সারি সারি কলমির ফুল। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে খালের পানিতে ঝাঁপ দেওয়া। কখনো কখনো ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কাদায় ফুটবল খেলতে যাওয়া। তারপর মায়ের বকাবকি, স্যারদের শাসন। মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। মাত্র কয়েকটা বছর হলো। অথচ আদতে যোজন যোজন দূরে হারিয়ে গেছে দুরন্ত শৈশব।