শীতের কুয়াশায় ছিন্ন আলো

প্রতীকীছবি: তানভীর আহাম্মেদ

শীতের সকালে সূর্যের আলো ম্রিয়মাণ, কুয়াশার পর্দা যেন পুরো শহরটাকে ঢেকে রেখেছে। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা গায়ে লাগলে কাঁপুনি ধরে যায়। শহরের এক কোণে রেললাইনের ধারে কুয়াশায় মোড়া এক অন্ধকার বসতি। সেখানে জীবন মানে প্রতিদিন নতুন সংগ্রাম। রেললাইনের পাশেই ছিন্নমূল মানুষের ছোট্ট খুপরি। ঘর তো নয়; বরং কাঠ, পুরোনো লোহা আর পলিথিনে গড়া অসম্পূর্ণ জীবনের এক ছবি। শীতকাল এলে এই বসতি আরও নিস্তব্ধ আর অসহায় হয়ে ওঠে।

এই বসতির মধ্যমণি আবির। ১০ বছরের ছেলেটি যেন বেঁচে থাকার প্রতীক। আবিরের মা মারা গেছে অনেক বছর আগে। বাবাও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। পৃথিবীর সঙ্গে এক অসম যুদ্ধের জন্য একা ফেলে রেখে গেছে। আবির এখন নানির সঙ্গে থাকে। বৃদ্ধ নানির কাঁধে বয়সের ভার আর মুখে একরাশ শূন্যতা। ভিক্ষা করেই দুজনের দিন চলে। যদিও ‘চলা’ কথাটাও এখানে বড় অযথা শোনায়।

আজ ভোরের আলোও যেন লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে কুয়াশার চাদরে। ঠান্ডা হাওয়া এসে একেক করে জীবনকে জড়োসড়ো করে দিচ্ছে। আবির ছেঁড়া স্যান্ডেল পায়ে আর ছেঁড়া সোয়েটার পরে রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্ষুধার তাড়নায় পেট চিৎকার করে উঠলেও সে চুপ। পকেটে আছে মাত্র দুই টাকা। এই টাকায় পেটের ক্ষুধা মেটাবে নাকি শীতের কামড় ঠেকাবে, জানা নেই।

কিছুক্ষণ পরে আবির একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দোকানদার বিরক্তি নিয়ে তাকায়।
‘কী চাস?’
আবির কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘একটা পাউরুটি দাও, কাকা।’
দোকানদার উপহাসের হাসি দিয়ে বলে, ‘পাউরুটির দাম পাঁচ টাকা। টাকা কম হলে অন্য কোথাও যা।’

আবির হতাশ হয়ে পেছনে ফিরে রেললাইন ধরে হাঁটতে শুরু করে। পায়ের নিচে কুয়াশায় ভেজা রেলপথ যেন তার জীবনের কঠিন পথের প্রতীক। হাঁটতে হাঁটতে সে দেখে, স্টেশনের এক কোণে কয়েকজন মিলে আগুন জ্বালিয়েছে। আবির দূর থেকে তাকিয়ে থাকে। চঞ্চল চোখে একরাশ প্রশ্ন আর আশার আলো। কিন্তু সে কাছে যায় না, ভীত আর লজ্জিত। আগুনের উষ্ণতা তার জন্য নয়, এই বাস্তবতা সে বুঝে গেছে খুব অল্প বয়সেই।

হঠাৎ রাস্তার এক পাশে ভিড় দেখতে পায়। ধনী মানুষদের কেউ পুরোনো শীতবস্ত্র বিতরণ করছেন। আবিরের বুকের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশা জাগে। লজ্জা-সংকোচ দূরে সরিয়ে লাইনের এক কোণে দাঁড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ বিরক্তির চোখে তাকায়, আবার কেউ একটুখানি দয়া দেখায়। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সে পায় একটা পুরোনো কম্বল।

আবির কম্বলটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। যেন শীতের তীব্রতার বিরুদ্ধে সে একটা ঢাল পেয়েছে। কিন্তু এই ঢালটা শুধু তার জন্য নয়, নানির জন্যও। ছোট্ট খুপরিতে ফিরে গিয়ে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে, ‘নানি! দেখো, তোমার জন্য কম্বল এনেছি। এবার আর শীত লাগবে না তোমার।’

নানি কাঁদতে কাঁদতে আবিরকে বুকে জড়িয়ে ধরে। এই কান্না দুঃখের নয়; বরং কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসার। আবিরের ছোট্ট হাতের এই চেষ্টাই যেন পুরো শীতের রাতটাকে উষ্ণ করে তোলে।

পটিয়া, চট্টগ্রাম