দীর্ঘশ্বাস

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চর বাগমারার বড় খালটার ওপারে সূর্য ডুবতেই চারপাশে অন্ধকার নামতে শুরু করল। ঝিঁঝিপোকার কাব্যিক ছন্দে নামা সে অন্ধকারের শব্দে গাছের পাতাগুলো নুয়ে পড়ছিল। পাখিরা দিনের শেষ গান গেয়ে বাসায় ফিরছে। চারপাশের নিঝুম পরিবেশে ঝিঁঝিপোকার ডাকের ফাঁকে কারও পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। পুরোনো সাইকেলে ক্লান্ত শরীরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আবদুল গফুর।

এই খালের পাড় দিয়ে আসতে প্রতিবারই ওর মনে ভেসে উঠে সেদিনের রক্তাক্ত খালটার কথা। তাজা রক্তের গন্ধে বিষাক্ত বাতাসে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। বড় একটি নৌকায় পাকিস্তানি বাহিনীর গ্রাম লুটের খবর শুনে এসেছিল ওরা। নিজেদের দলের মধ্যেই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর গুপ্তচর, মুক্তিরা এদিকে আসছে এই খবর আগে থেকে পেয়ে শক্ত অবস্থানে অপেক্ষা করছিল মিলিটারিরা। নৌকা দেখতে পাওয়ামাত্রই গুলির বৃষ্টি শুরু হলো। গফুর মিয়ার সঙ্গে আরও দু-একজন নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নেমে আড়ালে বড় বড় কচুরিপানার মধ্যে ডুব দিয়ে থাকলেন। আধঘণ্টার মতো চলল গুলির শব্দ। খালের পানি লাল রং ধারণ করল। নিজেদের ভাইয়ের রক্তের মধ্যে ডুব দিয়ে থাকলেন গফুর মিয়া। এই পথ দিয়ে আসার সময় প্রতিবারই দৃশ্যগুলো মনে পড়ে তাঁর।

সাধারণত এ পথে তিনি বাড়ি ফেরেন না। যেদিন খুব বেশি তাড়াহুড়া থাকে অথবা শরীরে ক্লান্তি ভর করে, সেদিনই এ পথে আসেন গফুর মিয়া। ছোট্ট একটি পাটকাঠির ঘর, ওপরে গোলপাতার ছাউনি। ঘরের সামনের এক হাত বারান্দায় বসে উদাস মনে পশ্চিম আকাশের অস্তমিত সূর্যের দিকে বৃদ্ধা তাকিয়ে আছেন। সাইকেলের বেলের টুংটাং শব্দে চৈতন্য ফেরে। গফুর মিয়ার হাত থেকে সাইকেলটা নিয়ে হাত পাখাটা বাড়িয়ে দেয়। মাটির বারান্দায় এসে বসে বৃদ্ধ দম্পতি। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শক্তিহীন কাঁধে মাথা রেখে কান্না ধরা গলায় প্রশ্ন করে, ‘বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ হলো?’ বৃদ্ধের উদাস দৃষ্টি সন্ধ্যার এই আলো–আঁধারিতে ঝাপসা হয়ে আসে। উত্তর দেয়, ‘আজ বাজারের লাইনে নেটওয়ার্ক ছিল না। কাল নিশ্চয়ই কথা হবে। বাবুকে বললেই টাকা পাঠাবে, তুমি ভেবো না।’ বাবু তাদের একমাত্র জীবিত সন্তান। বড় মেয়ে অনেক আগেই মারা গেছে। আর বাবু উচ্চমাধ্যমিকের পর ঢাকার একটি কলেজে পড়াশোনা শেষে এখন একটি বেসরকারি মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসে চাকরি করছে। ঢাকাতেই বিয়ে করেছে। সেখানেই থাকছে। মা-বাবার খোঁজখবর নেয় না।

প্রতিদিন ভোরে কাগজ এনে তা অফিসে অফিসে পৌঁছাতে সাইকেল নিয়ে ছুটেন গফুর মিয়া। আজ ২৬ মার্চে সব শ্রেণির চাকরিজীবীর ছুটি থাকলেও গফুর মিয়ার ছুটি নেই। কয়েকটা অফিসে খবরের কাগজ পৌঁছে দিয়ে বাজারের দোকানগুলোতেও কাগজ দিতে আসছেন তিনি।

দোকানগুলোয় দেশের পতাকা উড়ছে। দেখেই মনটা ভরে উঠল বৃদ্ধের। পাকা সাদা রঙের দাড়ির আড়ালে ফোকলা দাঁতের একচিলতে হাসি শুভ্রতা ছড়িয়ে দিল। মাইকে বাজছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর স্বাধীনতার গান। চায়ের দোকানের জটলা দেখে সাইকেল রেখে এগিয়ে গেলেন গফুর মিয়া। সবাই গোল হয়ে টিভি দেখছেন। ভিড়ের পেছন থেকে উঁচু হয়ে দেখলেন টিভিতে স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ দেখানো হচ্ছে। বিশেষ আগ্রহ দেখালেন না তিনি। এই কুচকাওয়াজ তার পেটের খিদে মেটাতে পারবে না। সাইকেলের শক্ত প্যাডেলে দুর্বল পা দিয়ে আঘাত করে এগিয়ে গেলেন বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধার কোনো সুবিধা তিনি ভোগ করতে পারেননি। সিস্টেম জটিলতা না কিসের দোহায় দিয়ে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের কার্ডটি করা হয়ে ওঠেনি। স্থানীয় একজন সাংবাদিক তাঁকে পত্রিকা বিলির কাজটি দেন। এটির ওপর নির্ভর করেই চলছে সংসার। সাংবাদিকের অনুগ্রহটুকু না পেলেও গফুর মিয়া বেঁচে থাকতেন। ক্ষুধার কষ্ট তাঁর নতুন নয়, ক্ষুধার সঙ্গে মিতালি বহুদিনের। মৃত্যু পর্যন্ত থাকবে এই মিত্রতা। চলতে থাকবে মুক্তির জন্য যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ!

বন্ধু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা