শীত নাকি বিষাদের হাওয়া

শীতের সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে বাবার সঙ্গে স্কুলে যাচ্ছে শিশুটি। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পিয়ারাখালী থেকে ছবিটি তোলাছবি: হাসান মাহমুদ

প্রকৃতিতে শীত শীত গন্ধ অনুভূত হচ্ছে, বাতাসে টের পাচ্ছি মৃদুমন্দ হিমেল পরশ। ভোরবেলা বারান্দায় দাঁড়ালে; সাদা চাদর টেনে দৃষ্টিতে বাঁধ সাধছে কুয়াশা। ছাদের গাছগুলোর গা ধুয়ে দিচ্ছে শিশির। প্রকৃতিতে মিষ্টি সোনারাঙা রোদ আঁকিবুঁকি করছে; গ্রীষ্মের কাঠফাটা দাবদাহ নেই, নেই বর্ষার অঝোর ধারায় ভিজে যাওয়াও। এ যেন শীতের আগমনী বার্তা। শীত এসব আভাসের মাধ্যমে প্রকৃতির কানে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে, আমি এসেছি গো তোমার উঠোনে; লও হে মোরে বরণ করে।

শীতের আগমনে ধরায় বিষণ্ন সুন্দরের একটি রূপ দৃশ্যমান হয়; মনে হয় প্রকৃতির ডানায় বিষণ্নতা ভর করেছে। বেলা বাড়তে না বাড়তেই কেমন ছায়া পড়ে রাত নেমে আসে ধরণীতে, নেমে আসে সুনসান নীরবতা— শুরু হয় ঝিঁঝিঁপোকার ডাক আর জোনাকির ওড়াউড়ি। কেন জানিনা, এই বিষণ্ন প্রকৃতির সঙ্গে, আমিও এই সময় বিষণ্নতার সমুদ্রে তলিয়ে যাই। ন্যাফথলিন দিয়ে আলমারিতে তুলে রাখা নতুন কাপড়ের মতো, যত্ন করে ঢেকে রাখা স্মৃতিরা— দিকভ্রান্ত প্রজাপতির মতো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। হাঁসফাঁস করতে থাকে পাঁজরের ভেতর থাকা হৃৎপিণ্ড। রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বিষণ্নতার ব্যথা— আমি আগলাতেও পারি না, ফেলতেও পারি না। স্মৃতির সাম্পান এসে বিষাদের ঘাটে নোঙর ফেলে, শুরু হয় পাওয়া না পাওয়ার হিসাব-নিকাশ। মনে হয়, জগতে যেন কিছুই নেই; কোনোদিন আমার জন্য কিছুই ছিল না— বিরানভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ এক হিজলগাছ আমি।

সেদিন সন্ধ্যার মুখে, আকাশ দেখার উদ্দেশে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়েছি—এ সময়ের আকাশ সাজে নানা রূপে; কখনো নীলাভ সাদা, কখনো–বা গায়ে মাখে গোধূলির নানা রং। আকাশে এলোমেলো ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। আমি ছাদের রেলিংয়ে দুহাতে ভর করে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে আছি— নীলের বুকে কিছু উদাসী মেঘ পশ্চিম থেকে পুবে ভেসে যাচ্ছে। আমি অপলক তাকিয়ে থেকে নীল-সাদার খেলা দেখছি। যখন আমার বিষণ্নতার বিষে দমবন্ধ লাগে, তখন আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এ আমার অনেক পুরোনো অভ্যাস।

পলকহীন আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি; পশ্চিমের রক্তিম আভা চোখে-মুখে এসে পড়ছে, মৃদু ঠান্ডা বাতাসে ছাদের গাছগুলোর পাতা নড়ার শব্দ টের পাচ্ছি— হঠাৎ কোনো এক পাখির ডাকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, ছাদের কার্নিশে গুটিসুটি হয়ে বসে দোয়েল ডাকছে; কিন্তু এ কেমন স্বর! এমন ভাঙা গলায় তো দোয়েল শিস দেয় না! ভাবলাম, দোয়েলকেও বুঝি প্রকৃতির বিষণ্নতা ছুঁয়ে দিয়েছে, তাই সে একা ছাদের কার্নিশে বসে—বিষাদের সুরে ডাকছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তার বিষাদী সুরের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছিলাম; কিন্তু কী মনে করে সে আমার দিকে তাকিয়ে বার কয়েক ডেকে, ফুড়ুৎ করে উড়াল দিয়ে অট্টালিকার ভিড়ে মিলিয়ে গেল।

চারদিকে অন্ধকার নেমেছে, অট্টালিকার কোটরে কোটরে জ্বলে উঠছে সাঁঝবাতি। অনুভব করলাম, অন্ধকার হবার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে শীতলতাও কিছুটা বেড়েছে। ছাদ থেকে নেমে কড়া লিকারে চা নিয়ে বারান্দায় বসেছি; বাসার পাশে অযত্নে বেড়ে উঠা ছাতিম ফুলের গন্ধে মাতাল লাগছে। ডুবে যাচ্ছি গন্ধের মাদকতায়। ছাতিম গাছের তলায় ৯-১০ বছরের এক ছেলে, গোটা কয়েক উনুন জালিয়ে— ভাপা, চিতই আর তেলের পিঠার পসরা সাজিয়ে বসেছে। শীত এলেই এই মানুষগুলো বাড়তি আয়ের একটা রাস্তা খুঁজে পায়। কয়েক দিন আগে এক সহকর্মীর সঙ্গে পিঠা খেতে গিয়েছিলাম ছাতিম তলায়, পিঠা খাচ্ছিলাম আর বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, ওর বয়সী আমার বাসার বাচ্চাদের এখনো মুখে তুলে না খাইয়ে দিলে তারা হাতে তুলে খেতে পারে না; আর এই বাচ্চা এক হাতে চার চারটি উনুন সামলে নিচ্ছে! এদের কোনো বিষণ্নতা নেই, নেই জীবন নিয়ে কোনো অভিযোগও, পাওয়া না পাওয়ার হিসাবও এরা কষতে জানেনা— দিনশেষে আধপেটা খেয়ে–পরেই, বেঁচে থাকার আনন্দে তারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে।