সন্ধ্যা নামে নামে। ফাঁকা টেবিলটায় মিতু বসে আছে একপাশে। অন্যপাশের চেয়ারটা খালি। রেস্টুরেন্টে এরই মধ্যে মানুষ আসতে শুরু করেছে। সাউন্ড বক্স থেকে মৃদুস্বরে ভেসে আসছে লাকী আখন্দের ‘আবার এল যে সন্ধ্যা…’। নিশু এখনো আসেনি। ছেলেটার পুরো নাম নিয়াজ মোর্শেদ। মিতু তাকে নিশু নামেই ডাকে। একা বসে থাকতে খুব একটা ভালো লাগছে না তার। ঠিক দুটো টেবিল পরেই এক যুগল বসে আছে। ছেলেটা মেয়েটাকে খাইয়ে দিচ্ছে। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে দিচ্ছে। মিতু আর নিশুর ৯৩ দিনের সম্পর্কে কোনো দিন এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি।
নিশুর ওপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ছেলেটা কল ধরছে না। তৃতীয়বারের মতো এমন হচ্ছে মিতুর সঙ্গে। এর আগেও দুইবার আসার কথা বলে আসেনি। প্রথমবার ঘুমের কারণে আসতে পারেনি। দ্বিতীয়বার আসেনি বৃষ্টি ছিল, তার ছাতা ছিল না তাই। আজ কেন আসছে না, সে কারণ এখনো জানা নেই। এই মুহূর্তে মিতু এখান থেকে উঠে যাবে কি না, সেটাও ঠিক করতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, ছেলেটা তাকে ভালোবাসে না। শেষবারের মতো আবার কল দিল। উত্তর নেই। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বাইরের রাস্তাটা দিয়ে একা একা হাঁটতে লাগল। মুঠোফোনটা রাগে বন্ধ করে দিয়েছে।
নিয়াজ মোর্শেদ শাহবাগের ফুলের দোকান তন্ন তন্ন করে খুঁজছে একগুচ্ছ দোলনচাঁপা। মৌসুম এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি। তাই কোথাও দোলনচাঁপা পাচ্ছে না। এটা ছাড়া মিতুর সামনে দাঁড়ানো মানে সাক্ষাৎ যমদূতের সামনে দাঁড়ানো। মেয়েটা প্রচণ্ড জেদি, অভিমানী। গতকাল তাদের ফোনে ২ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট এটা নিয়েই কথা হয়েছে। মিতুর খুব ইচ্ছা, তারা দোলনচাঁপা নিয়ে পাশাপাশি হাঁটবে। যদিও একবারও সে ফুল দেওয়ার কথা উল্লেখ করেনি। একটা ভাঙা বেঞ্চে বসে চা খেতে খেতে ভাবছে, কীভাবে এই ঝড় এড়ানো যায়। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে, ৩৭টা মিসড কল। মিতুর নম্বর থেকে। ফেসবুকে ঢুকে দেখে, ইতিমধ্যে একটা স্ট্যাটাসও দিয়ে ফেলেছে সে, ‘মেয়েটিকে কেউ দোলনচাঁপা দেয়নি’। নিয়াজ মোর্শেদের মনে বাজছে হায়দার হোসেনের গান—‘আমি ফাঁইসা গেছি…’।
একে একে সবার কমেন্ট পড়তে শুরু করল নিয়াজ। কেউ বলছে, ‘কোথায় নিয়ে আসব?’ কেউ বলছে, ‘আমি দিতে চাই।’ বেশির ভাগ মেয়ে লিখেছে, ‘us’। এখান থেকে কয়েকজনকে সে ইনবক্সে নক দিয়েছে যে ফুল কোথায় পাওয়া যাবে। কেউ মেসেজ সিনই করেনি। যে একজন করেছে, সে বলছে, ‘ফুলের দোকানে খুঁজলেই পেয়ে যাবে।’ কার জন্য দরকার, সেটাও জিজ্ঞেস করেছে। মিতুর ফোনে কল ঢুকেছে। রিসিভ করছে না। ফুল খোঁজার মিশন বাদ দিয়ে সে মিতুকে খোঁজার মিশনে নেমেছে। উঁকি মেরে সেই রেস্টুরেন্টেও দেখে এসেছে। কিন্তু খুঁজে পায়নি। পরে অবশ্য সামলে নিয়েছিল ব্যাপারটা। কিন্তু দোলনচাঁপা তখনো দেওয়া হয়নি।
মিতুর সঙ্গে নিয়াজ মোর্শেদের সম্পর্কটা টেকেনি বেশি দিন। দোলনচাঁপার মৌসুম পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগেই তাদের প্রেমের মৌসুম শেষ। একে অন্যের প্রতি অভিযোগ, অভিমানের পরিপ্রেক্ষিতে ১১৯ দিনের মাথায় সম্পর্কের ইতি টানে দুজন। কিন্তু মন থেকে তখনো কেউ কাউকে ছাড়তে পারেনি। ঠিকই একে অন্যের খোঁজখবর রাখে। এমনকি মাঝেমধ্যে দেখাও হয়ে যায় আচমকা। একদিন রেস্টুরেন্টে দেখা। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেনি। দুজন দুই কোণে বসেছে। এরই মধ্যে একটা ছেলে এসেছে দোলনচাঁপা হাতে। মিতুর টেবিলের দিকেই এগিয়ে যায়। নিশু ততক্ষণে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। নিজের চোখে দৃশ্যটা দেখতে চায়নি।
সেখান থেকে ফিরে নিয়াজ মোর্শেদের ভীষণ মন খারাপ। মিতুর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছে, মেনে নিয়েছে। কিন্তু আবার নতুন সম্পর্কের ব্যাপারটা সে নিতে পারছে না। ভেতরে ভেতরে ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ কথা কাউকে বলতেও পারছে না। এবার পুরোপুরি গুটিয়েই নিয়েছে নিজেকে। মিতুর সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাব্য সব জায়গা এড়িয়ে যাচ্ছে। একটা ট্যুরও সেরে ফেলেছে এর মধ্যে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। শূন্যতা পূরণ হচ্ছে না। তাকে কেউ ভালোবাসে না। বুঝতে পারে না।
মিতু অবাক হচ্ছে, ছেলেটার এভাবে লাপাত্তা হওয়া দেখে। কোনো উত্তরও খুঁজে পায়নি সে। পাঁচ দিন পর ফেসবুকে ঢুকতেই মিতুর প্রোফাইলে শেয়ার করা একটা ছবি সামনে আসে। রেস্টুরেন্টে সেদিনের ছেলেটা আর একটা মেয়ে বসা। সেটা মিতু নয়। তাদের মাঝখানে দোলনচাঁপা রাখা। ক্যাপশনে লিখেছে আগের লেখাটাই, ‘মেয়েটিকে কেউ দোলনচাঁপা দেয়নি’। নিয়াজ মোর্শেদ আজ আর বিলম্ব করেনি। বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে গেছে ফুলের দোকানের দিকে।
মিরপুর ১০, ঢাকা