মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের মধ্যে আমি তরুণ মজুমদারকে খুঁজে পেলাম। তাঁর কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘দুই নয়নের আলো’ যেন নিস্তব্ধ নিশির সৌরভ, সুবাস ছড়ানো রজনীগন্ধা, হৃদয়ের গহিনে গভীর ব্যথার অন্ধকারে মনের আলোয় আলোকিত। এত সুন্দর পারিবারিক–সামাজিক কাহিনির বুনন, এমন ধরে ধরে প্রতিটি দৃশ্য নির্মাণ, পরিশীলিত নান্দনিক কৃষ্টির ছাপ কিংবদন্তি পরিচালক তরুণ মজুমদারকে মনে করিয়ে দেয়।
উদ্বাস্তু পরিচালক তরুণ মজুমদারের প্রতিটি কাজ দুই বাংলা তথা গোটা বিশ্বের বাঙালির হৃদয় জয় করেছে। কিন্তু শুধু প্রচারের অভাবে ‘দুই নয়নের আলো’র মতো চলচ্চিত্রের কথা ভারতীয় বাঙালিরা জানতে পারে না। কথায় কথায় কাঁদতে পারে, অন্যের সুখে হাসতে পারে, লড়াই করে বাবা-মা ভাইয়ের সংসার ধরে রাখা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের কন্যা নিজের যত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য চাপা রাখতে পারে, মনের মানুষকে প্রাণ খুলে ভালোবাসতে পারে; এমন স্বতঃস্ফূর্ত সাবলীল অভিনয়, শাবনূরের মতো অন্তরে-বাইরে সুন্দরী অভিনেত্রীর আরও বড় জায়গা পাওয়ার প্রয়োজন ছিল। বুলবুল আহমেদের মতো অভিনেতা চলচ্চিত্র জগতের আচার্য আলমগীর কবীর, যাঁকে আবিষ্কার করেছিলেন, ঐতিহাসিক স্থান দিয়ে গিয়েছেন। এই চলচ্চিত্রে কোনো কোনো দৃশ্যে তাঁকে দেখে ভিক্টর ব্যানার্জীর কথা মনে এসেছে। ভারতীয় বাঙালিরা এমন সৃজনশীল সত্তাধারী অভিনেতাকে চিনে উঠতে পারলেন কোথায়?
প্রতিবছর দুর্গাপুজা বিজয়া দশমীতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে মহিষাসুরমর্দিনী দেখানো হতো। মহিষাসুরের ভূমিকায় বছরের পর বছর অভিনয় করে বাঙালির হৃদয় জয় করেছেন অমল বোস। এই চলচ্চিত্রে বিশেষ একটি বড় ভূমিকায় তিনিও রয়েছেন। আরও আছেন কিংবদন্তি প্রবীর মিত্র, রেহানা জলি, নায়ক ফেরদৌস আহমেদ এবং শাকিল খান। চলচ্চিত্রের দৃশ্য এবং ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনবদ্য প্রতিটি গান লিখে সুর করেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন, এন্ড্রু কিশোর, সুবীর নন্দী, কুমার বিশ্বজিৎ, মনির খান, বেবী নাজনিন। এককথায় সন্ধ্যা বেলার প্রদীপ জ্বালানো সেঁজুতিকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্রে রাতের আকাশে চাঁদের হাট বসেছিল। তরুণ মজুমদারের চলচ্চিত্রেও এভাবেই বিখ্যাত সব শিল্পীরা এসে জড়ো হতেন।
শুধু পারিবারিক সামাজিক বন্ধনের গল্প তো নয়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষিক মানবিক সম্পর্কের বন্ধনের পাশাপাশি বৃহত্তর দেশপ্রেমের বন্ধনের বার্তাও রয়েছে। জার্মানিতে বড় হওয়া বাঙালি পরিবারের সন্তান তানভীর আহমেদ আকাশ শিকড়ের সন্ধানে বাংলাদেশ ঘুরে দেখতে, টাঙ্গাইলে দাদুকে দেখতে দেশের মাটিতে পা রেখেছেন। যার দুই নয়নের আলোতে এই চলচ্চিত্র আলোকিত, সেই সেঁজুতি নামের ভ্রমণসঙ্গী গাইড, নিজের পছন্দ মতো আকাশকে সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ দেখাতে নিয়ে যায়। সেঁজুতির ধারণা ছিল বাইরের দেশে বড় হওয়া আকাশ মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী বেদনার ইতিহাস এবং বাংলাদেশিদের প্রাত্যহিক জীবনে এই ইতিহাসের প্রভাব সম্পর্কে তেমন ওয়াকিবহাল নয়। কিন্তু বাঙালিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেশে-বিদেশে যে যেখানেই মানুষ হোক না কেন, বুকের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে চলে। সেঁজুতিকে অবাক করে দিয়ে আকাশ স্মৃতিসৌধে দাঁড়িয়ে প্রাণ খুলে গেয়ে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...’। ছোট বড় অনেকেই পাশে এসে দাঁড়িয়ে দেশপ্রেমের গানে হৃদয় উজাড় করে দেয়।
বেশ কয়েকদিন টাঙ্গাইলে গিয়ে থাকাতে সেঁজুতির বাবাও ভুল বুঝে মেয়েকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। অফিস কলিগ অমল বোসের বাড়িতে গিয়ে তখন আশ্রয় নেয়।
এই বিলেতফেরৎ ডাক্তার আকাশের একটা ভুল হয়েছিল, টাঙ্গাইলে জমিদার দাদুর কাছে গিয়ে দাদু যখন নিজের পছন্দের দেশের মেয়েকে বিয়ে করে দেশের মাটিতে থেকে যাওয়ার কথা বলছেন, আকাশ মুখ ফসকে বলে ফেলেছে, ঢাকাতে এসে মাত্রই একজনকে দেখে ভালো লাগাতে সে বিয়ে করে নিয়েছে। দাদু তখন নাতবউকে নিয়ে আসতে বলেন। আকাশ সেঁজুতিকে গিয়ে ধরে অর্থের বিনিময়ে বউ সাজার জন্য।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কন্যা সেঁজুতির আত্মসম্মানের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার গল্প নিয়েই তো এই চলচ্চিত্র। হঠাৎ ব্রেন টিউমার ধরা পড়াতে জীবন বিধ্বস্ত, বেঁচে থাকার দিন ফুরিয়ে আসছে, বাবা-মাকে একটা মাথার গোঁজার ঠাঁই বাড়ি করে দিতে হবে, ভাইকে বিদেশ পাঠাতে হবে, নিজের চিকিৎসা করানোর চেয়েও এসব কাজ তার কাছে অনেক জরুরি। নিজের চাকরির আয়ে অল্প সময়ে এতকিছু করা সম্ভব নয়। তাই মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও আকাশের প্রস্তাবে রাজি হতে হয়। এই খেলা খেলা বউ সাজাতে গিয়ে আকাশের বুঝতে ভুল হয়েছিল, বাঙালি কন্যার জীবনে বৈবাহিক বন্ধন কোনো ছেলেখেলা নয়।
নকল বউ সেঁজুতি আকাশের বাড়িতে গিয়ে নিজের বাড়িতে বাবা-মা ও ভাইয়ের যেভাবে পরিচর্চা করত, সেভাবেই আদর যত্নে ভালোবাসায় দাদুসহ সবার মন জয় করে নেয়। নকল বউয়ের অভিনয় করতে এসেও আসলে সে যে অভিনেত্রী নয়, সহজ সরল বাঙালি পরিবারের লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। আকাশেরও মনে ধরে যায় সেঁজুতিকে; কিন্তু চুক্তিমত ফিরিয়ে দিতে হয়। সেঁজুতিও মনে মনে জানে দিন ফুরিয়ে আসছে। এভাবে সম্পর্কের মধ্যে ডুবে গিয়ে কাউকে ঠকাতে সে পারবে না।
বেশ কয়েকদিন টাঙ্গাইলে গিয়ে থাকাতে সেঁজুতির বাবাও ভুল বুঝে মেয়েকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। অফিস কলিগ অমল বোসের বাড়িতে গিয়ে তখন আশ্রয় নেয়। সেঁজুতির অসুস্থতা, দিন ফুরিয়ে আসা, লড়াই–সংগ্রামের সব কথা এই বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মীই শুধু জানত। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মী এবং তাঁর স্ত্রীর পরিবারে বাড়ি ছেড়ে আসা তরুণী সেঁজুতির সম্পর্ক, মানুষের জীবনের চলার পথে বহুমুখী সুন্দর সম্পর্কের মধ্যে অন্য একটি গতিপথ।
আরও এক ধরনের সম্পর্কের গল্প পরিচালক তুলে এনেছেন চলচ্চিত্রে। একইসঙ্গে এক নীরব এবং সরব প্রেমিক শাকিল, শাকিল খান। সেঁজুতিকে সে হৃদয় ভরা এক সমুদ্রের জলের মতো ভালোবাসে। সেঁজুতি তাকে এড়িয়ে চলে, সেঁজুতির ভাই গায়ে হাত তোলে, প্রেমিক তবু কিছুতেই রেগে উঠতে জানে না। প্রতিহিংসায় জড়াতে জানে না। এক পাক্ষিক প্রেম তাকে সর্বক্ষণ সেঁজুতিময় করে রাখে। দুই সাগরেদকে নিয়ে তবু সে সেঁজুতির পিছু ঘোরে, সেঁজুতির ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করে থাকতে রাজি। সেঁজুতি হারিয়ে গেলে নিজেকেও ক্ষয়ে ফেলে। সেঁজুতি অসুস্থ, জীবন–মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে জানার পর ঈশ্বরের দুয়ারে গিয়ে মাথা কুটে মরে। সেঁজুতি অন্যকে বরণ করে নিচ্ছে জানার পরেও ভালোবাসা ফুরোয় না। দুঃখঘন চিত্তে অবনত প্রেমিক মন ভালোবাসার পাখিকে আকাশে উড়িয়ে দেয়।
আর ডাক্তার আকাশ নিজে অপারেশন করে সেঁজুতিকে সুস্থ করে তোলে। গভীর দুঃখের তিমিরেও আমাদের সামনে দুই নয়নের আলো জেগে ওঠে, জ্বলে ওঠে। হারতে হারতেও এক লড়াকু তরুণী জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়। একটি সুন্দর চলচ্চিত্রের কাছে আমরা এর বেশি আর কী আশা করতে পারি! আমাদের বন্ধ চোখ খুলে দিতে পারে এই দুই নয়নের আলো। আমাদের অন্ধ হৃদয়ে আশা জাগায় দুই নয়নের আলো। পরতে পরতে এমন আবেগসঞ্চারী চলচ্চিত্রের কথা বহুকাল মনে থাকবে।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত