কেন ‘সেরাদের সেরা’ হতে পারছেন না নেইমার

কবে মাঠে ফিরবেন নেইমার?ছবি: রয়টার্স

একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব ফুটবলে সবচেয়ে বড় আক্ষেপের নাম কী? একেক জনের জবাব একেক রকম হতে পারে। কেউ বলবেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বিশ্বকাপ জিততে না পারা, কারও কাছে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে জিনেদিন জিদানের বিতর্কিত সেই ‘মাথা দিয়ে আঘাত’ করা; ওই কাজটি না করলে হয়তো তাঁর হাতেই দ্বিতীয়বারের মতো শোভা পেত সোনালি ট্রফিটি। আবার কারও মতে, বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্মের আন্তর্জাতিক কোনো ট্রফি না জেতা।

এ ছাড়া আরও অনেক গল্প রয়েছে। তবে সেসব ছাড়িয়ে অন্যতম বড় আক্ষেপের নাম সম্ভবত ‘নেইমার দা সিলভা সান্তোস জুনিয়র’। নেইমার নামেই তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত। আন্তর্জাতিক মঞ্চে অভিষেকের আগে থেকেই বিশ্ব ফুটবলের বড় শিরোনামে পরিণত হন এই ব্রাজিলিয়ান। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে ২০১০ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে কেন তাঁকে রাখা হয়নি, তা নিয়ে তৎকালীন কোচ কার্লোস দুঙ্গার ব্যাপক সমালোচনা হয়। এমনকি দেশটির কিংবদন্তি অনেক সাবেক ফুটবলারও নেইমারকে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে রাখার দাবি জানিয়েছিলেন!

নেইমারকে ঘিরেই ব্রাজিলের যত স্বপ্ন
ছবি: নেইমার টুইটার

২০০৯ সালের ৭ মার্চ মাত্র ১৭ বছর বয়সে ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব সান্তোসের হয়ে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক নেইমারের। ওয়েস্তের বিপক্ষে ওই ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে তিনি যখন প্রথমবারের মতো মাঠে নামেন, তখন পুরো গ্যালারি ‘নেইমার’ বলে জয়ধ্বনি দিচ্ছিল। অবশ্য ম্যাচটিতে কোনো গোল করতে পারেননি তিনি। তবে দুর্দান্ত ফুটবলীয় নৈপুণ্য প্রদর্শন করে সমর্থকদের মন জয় করে নেন। পরের সপ্তাহে প্রথম গোলের দেখা পান এই বিস্ময়বালক। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের প্রথম মৌসুমে ক্লাবের হয়ে ৪৮ ম্যাচে ১৪ গোল করেন।

পরের বছর ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক ঘটে তাঁর। সান্তোসের হয়েও গড়তে থাকেন একের পর এক রেকর্ড। ২০১০-১১ মৌসুমে ৬০ ম্যাচে ৪২ গোল এবং ৯ অ্যাসিস্ট, ২০১১-১২ মৌসুমে ৪৭ ম্যাচে ৪৩ গোল এবং ১৬ অ্যাসিস্ট, ২০১২-১৩ মৌসুমে ৪৭ ম্যাচে ৪৩ গোল এবং ৯ অ্যাসিস্ট। ২০১২-১৩ মৌসুমে সান্তোসের হয়ে খেলে ওই বছর তিনি প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি’অর মনোনয়ন পান এবং শেষ পর্যন্ত তালিকায় দশম স্থান অর্জন করেন। সে বছরই বার্সেলোনায় পাড়ি জমান নেইমার। এরপর ২০১৬-১৭ মৌসুম পর্যন্ত কাতালান ক্লাবটিতে তাঁর গল্প কেবল উত্থানের।

লিওনেল মেসি, নেইমার আর সুয়ারেজ যখন বার্সায় ছিলেন
ছবি: ফাইল ছবি

এর মধ্যে ২০১৪-১৫ মৌসুমটি তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। লিওনেল মেসি এবং লুইস সুয়ারেজের সঙ্গে জুটি গড়ে ‘এমএসএন’ ত্রয়ী নামে বিশ্বসেরা আক্রমণভাগে পরিণত হন। জয় করেন ঐতিহাসিক ‘ট্রেবল’ শিরোপা-লা লিগা, কোপা দেল রে এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ। সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৫১টি ম্যাচ খেলে গোল করেন ৩৯টি এবং সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরও ১১টি। এই পারফরম্যান্সের সুবাদে প্রথমবারের মতো জায়গা করে নেন ব্যালন ডি’অর তালিকার শীর্ষ তিনে। তাঁর আগে ছিল কেবল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসি। জায়গা করে নেন চ্যাম্পিয়নস লিগের মৌসুমসেরা একাদশেও।

বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘মানুষের মনে সুখ বেশি দিন ভালো লাগে না।’ নেইমার হয়তো কথাটিকে বেশি সিরিয়াসভাবে নিয়ে নেন। ২০১৭-১৮ মৌসুমে রেকর্ড ট্রান্সফার ফির বিনিময়ে বার্সেলোনার সুখের সংসার ছেড়ে পাড়ি জমান পিএসজিতে। গুঞ্জন ছিল, বার্সায় থাকলে সব সময় মেসির ছায়া হয়ে থাকতে হবে; যা ব্যালন ডি’অর জয়ে সবচেয়ে বড় বাধা! তাই আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির ছায়া ছেড়ে প্যারিসে চলে যান। লক্ষ্য, ব্যালন ডি’অর জয় এবং পিএসজির হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জেতা। ফ্রান্সে প্রথম মৌসুমটা বেশ ভালো কাটানও। সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩০ ম্যাচে ২৮ গোল করেন এবং সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরও ১৬টি। কিন্তু এর পরের গল্পটা কেবলই হতাশার। যে লক্ষ্যে প্যারিসে এসেছিলেন তা-তো পূরণ হয়নি, উল্টো প্রতি মৌসুমের অর্ধেকটা সময় চোটের কারণে মাঠের বাইরে থাকতে হচ্ছে। ক্লাবটির হয়ে সর্বোচ্চ সফলতা বলতে ২০২০ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলা।

আহা, কী আনন্দ! ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সবচেয়ে বড় অতৃপ্তি ঘোচানোর পর। রিও অলিম্পিক ২০১৬

এটা তো গেল ক্লাবের কথা। ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়েও এখন পর্যন্ত কোনো বড় শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে পারেননি। সর্বোচ্চ সফলতা ২০১৩ সালের ফিফা কনফেডারেশন কাপ এবং ২০১৬ সালে অলিম্পিক গোল্ড মেডেল। কিন্তু এই দুটি শিরোপা তেমন বড় নয়। বিশ্বকাপ খেলেছেন তিনটি। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ঘরের মাঠে কলম্বিয়ার বিপক্ষে চোট পেয়ে প্রথমবার স্বপ্নভঙ্গ হয়। ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে শুরু থেকেই চোটের হানা ছিল। এ কারণে নিজের সেরাটা দিতে পারেননি। উল্টো ট্র্যাকলের শিকার হয়ে বারবার ডাইভ দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়েন। সর্বশেষ ২০২২ বিশ্বকাপে বড় স্বপ্ন নিয়ে কাতার গিয়েছিলেন। দুর্দান্ত ফর্মের পাশাপাশি শারীরিক এবং মানসিকভাবেও ছিলেন সম্পূর্ণ ফিট। কিন্তু এবারও স্বপ্নভঙ্গ। গ্রুপ পর্বে একবার চোটে পড়েন। কোয়ার্টার ফাইনালে চোট থেকে ফিরেও অতিমানবীয় পারফরম্যান্স দেখিয়ে দলকে সেমিফাইনালে প্রায় নিয়েই যাচ্ছিলেন! শেষ মুহূর্তে সেটা আর হলো না। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ওই ম্যাচটি হারের পর মাঠে নেইমারের কান্না এখনো ফুটবলপ্রেমীদের চোখে ভোসে।

অবশ্য এর মধ্যে একটিবার আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতার সুযোগ ছিল নেইমারের সামনে। ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকা জয় করে ব্রাজিল। কিন্তু চোটের কারণে ওই দলটিতে ছিলেন না দেশটির পোস্টার বয়। শিরোপাও আর উঁচিয়ে ধরা হয়নি। আক্ষেপ হয়তো একেই বলে। তাই তো কাতার বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের পর অভিমানে বলেছিলেন, হয়তো আর হলুদ জার্সিতে ফিরবেন না। এরপর ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এখনো তিনি ব্রাজিল জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেননি। নিজেও চোট থেকে পুরোপুরি সুস্থ হননি। সুস্থ হলেও ফিরবেন কি না, তা এখনো বলা যাচ্ছে না।

ব্রাজিলের হয়ে পেলের সর্বাধিক গোলের রেকর্ড ছোঁয়ার পর নেইমার
ছবি: রয়টার্স

তবে ব্রাজিলের হয়ে এরই মধ্যে নিজেকে সর্বকালের সেরাদের কাতারে নিয়ে গেছেন নেইমার। ১২৪ ম্যাচ খেলে করেছেন যৌথভাবে সর্বাধিক ৭৭ গোল। সমানসংখ্যক গোল নিয়ে এত দিন এককভাবে শীর্ষে ছিলেন ফুটবলের ‘রাজা’ খ্যাত পেলে। আর গোল করানোর দিক দিয়ে অনেক আগেই সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন পিএসজি তারকা। সেলেসাওদের হয়ে তাঁর অ্যাসিস্ট সংখ্যা ৫৬। ৪৭টি অ্যাসিস্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন পেলে।

দিন শেষে ফুটবলে তাঁকেই সেরা মানা হয়, যিনি ব্যক্তিগত অর্জনের পাশাপাশি ক্লাব এবং জাতীয় দলের হয়েও বড় বড় শিরোপা জয় করেছেন। তাই তো নেইমার ব্রাজিলের জন্য কিংবদন্তি হলেও এখনো বিশ্ব ফুটবলে সেরাদের সেরা হতে পারেননি। বড় কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা এবং ব্যালন ডি’অর জয় কেবল তাঁকে এই স্বীকৃতি এনে দিতে পারে। এ জন্য নেইমারকে আবারও ফিরতে হবে হলুদ জার্সিতে। ফুটবল যে তাঁর কাছে এখনো অনেক ঋণী।