কবি সৈয়দ আলাওল ছিলেন মধ্যযুগের সর্বাধিক গ্রন্থপ্রণেতা। তিনি বহুভাষাবিদ এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন। ‘পদ্মাবতী’, ‘সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল’, ‘হপ্তপয়কর’, ‘সিকান্দারনামা’ ও ‘তেয়াফা বা তত্ত্বোপদেশ’ অন্যতম রচনা।
মধ্যযুগের কিংবদন্তি কবি সৈয়দ আলাওল ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁকে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কবিদের মধ্যে বিশেষত মুসলমান কবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয়। তাঁর পাণ্ডিত্যের পটভূমি শতাব্দী ধরে মুগ্ধ করেছে মানুষকে।
জন্মস্থান নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা মতবিরোধ থাকলেও অনেকের মতে, ১৬০৭ সালে ফরিদপুর জেলার ফতেয়াবাদ পরগনার জামালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আলাওল। আবার অনেকে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন বলেও দাবি করেন।
একবার জলপথে নৌকাযোগে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে আলাওল ও তাঁর পিতা পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হন। এ ঘটনায় পিতা জলদস্যুদের হাতে নিহত হন। জলদস্যুরা আহত আলাওলকে বন্দী করে ক্রীতদাস হিসেবে আরাকানে (বর্তমান মিয়ানমারের একটি রাজ্য) নিয়ে যায়। তখন তাঁর বয়স কম ছিল। পরে জীবনের অধিকাংশ সময় আরাকানেই কেটেছে। তবে সেখানে খুব একটা ভালো ছিলেন না। কবি তাঁর ‘সিকান্দারনামা’ কাব্যে ভাগ্য বিড়ম্বনার চিত্র তুলে ধরেন এভাবে—
‘মন্দকৃতি ভিক্ষাবৃত্তি জীবন কর্কশ
দারাপুত্র সঙ্গে অঙ্গ হৈল পরবশ’
কবি সৈয়দ আলাওল ছিলেন বহুবিদ্যায় বিদ্বান। তাঁর রচনা থেকে পাওয়া যায় যে তিনি যোগশাস্ত্রে অনেক পারদর্শী ছিলেন। আরবি, ফারসি, মৈথিলী, প্রাকৃতপৈঙ্গল, ব্রজবুলি এবং বাংলা ও সংস্কৃতসহ অনেক ভাষা আয়ত্তে ছিল। এ ছাড়া অনুবাদে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কাব্যধারায় কবিদের কবিত্ব বৈশিষ্ট্য বিচারে আলাওল সে যুগের শীর্ষস্থানীয় কবির মর্যাদা পান। নিশ্চিত করে বলা যায়, কবিতার প্রতি আলাওলের প্রতিভা ছিল অতুলনীয়। কাব্যতত্ত্ব, অলংকার, শাস্ত্র ও ছন্দবিজ্ঞানে ছিলেন পারদর্শী।
তাঁর কবিতাগুলো পাঠকের মনে গভীর আবেগ ও চিন্তাভাবনা জাগিয়েছে। অল্প বয়স থেকেই তিনি বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। কাব্যপ্রতিভার পরিচয় প্রকাশ পেলে একসময় তিনি হয়ে পড়েন রাজসভার কবি। তাঁকে কাব্যচর্চায় বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন রাজার একজন প্রধান কর্মচারী মাগন ঠাকুর।
কবি সৈয়দ আলাওল ছিলেন মধ্যযুগের সর্বাধিক গ্রন্থপ্রণেতা। তিনি বহুভাষাবিদ এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন। ‘পদ্মাবতী’, ‘সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল’, ‘হপ্তপয়কর’, ‘সিকান্দারনামা’ ও ‘তেয়াফা বা তত্ত্বোপদেশ’ অন্যতম রচনা। হিন্দু ও মুসলমান শাস্ত্রেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। আলাওলের রচনা সরল অথচ প্রগাঢ়। ‘পদ্মাবতী’ তাঁর শ্রেষ্ঠ আখ্যায়িকা। আলাওলের কাব্যমালায় গান বা পদাবলিও আছে। তাঁর প্রধান কাব্য ‘পদ্মাবতী’, যা ছিল কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর হিন্দি কাব্য ‘পদুমাবৎ’-এর অনুবাদ।
আলাওল সেই কাব্যে ইতিহাসের পটভূমিতে মানবীয় প্রেমের কাহিনি পরিবেশন করেছেন।
‘প্রেমে বিনে ভাব নাই ভাব বিনে রস
ত্রিভুবনে যাহা দেখি প্রেম হুনতে বশ
যার হূদে জন্মিলেক প্রেমের অঙ্কুর
মুক্তি পাইল সে প্রেমের ঠাকুর।’
সবার অরাধ্য প্রেমের নিমিত্তে কবির কি অসাধারণ কাব্যকথা! প্রেম নিয়ে লেখা এই চারটি চরণ পাঠে প্রেমের অন্তহীন মহিমা এবং মাহাত্ম্য দারুণভাবে ফুটে উঠেছে।
মধ্যযুগীয় ধর্মপ্রচারমূলক বাংলা সাহিত্যধারার রচনাগুলোয় এ ধরনের মানবীয় বিষয়ের অবতারণা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বাংলা সাহিত্যে কাব্যটির বিশেষ মূল্য রয়েছে। কাহিনি ও কাব্যগুণের জন্য ‘পদ্মাবতী’ হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
‘সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল’ বাংলা ভাষার রোমান্টিক কাব্যধারার অন্যতম বিশিষ্ট কাব্য। দোনা গাজী চৌধুরী, আলাওল, ইব্রাহিম ও মালে মুহম্মদ—এই প্রেমকাহিনি অবলম্বনে কাব্যরচনা করেছিলেন। তার মধ্যে আলাওলের কাব্যই সমধিক পরিচিত। ‘সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল’ কাব্যের কাহিনির আদি উৎস আলিফ লায়লা বা আরব্য উপন্যাস। প্রেমমূলক কাহিনিকাব্য হিসেবে এর পরিচয়। রচনাকাল প্রায় ১৬৬০ সালের আগে।
কবি আলাওল দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রাণী’ গ্রন্থে মোহাম্মদের ‘সিফত’ বয়ান করেছেন এভাবে—
‘আহাদ আছিল এক
মিম হন্তে পরতেক।
যে মিমেত জগৎ মোহন’
মধ্যযুগের একজন কবির শব্দচয়ন, ভাবনার বিস্তার এবং বাক্যগঠন আজও সচেতন পাঠকমহলে সমাদৃত। কবির যেমন সুর, তাল, লয় জ্ঞান আছে, তেমনই আছে শুদ্ধ ছন্দ ও মাত্রাজ্ঞান। আলাওলের ভেতর যে সত্যিকারের একজন কবি লুকিয়ে আছে তা মাগন ঠাকুর আগেই টের পেয়েছিলেন।
আলাওলের খ্যাতি দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ায় তিনি জনগণের কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। খ্যাতি অর্জন সত্ত্বেও তিনি একজন নম্র এবং বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে রয়ে যান।
এটা বলা যায়, আলাওলের কবিতায় ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাব ছিল গভীর ও সুদূরপ্রসারী। প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে আরবি ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য, ইসলামি সংস্কৃতি তাঁর কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গির গঠন তৈরি করেছে। তাঁর রচনাগুলো পাঠকদের তাদের নিরবধি সৌন্দর্য এবং মানব অভিজ্ঞতার গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনুপ্রাণিত করে। যা সাহিত্যের জগতে ইসলামি সংস্কৃতির স্থায়ী উত্তরাধিকারকে প্রতিফলিত করে।
তারাগঞ্জ, রংপুর