হৃদয়ের অ্যানাটমি করতে শেখায় যে ‘নতুন বউ’

‘নতুন বউ’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যছবি: সংগৃহীত

কাজী জহির আর চিত্রা জহিরের চলচ্চিত্র মানেই বেশ ফুরফুরে মেজাজের প্রেমের কাহিনি। আবার প্রেমের কাহিনি দুই ধরনের হতে পারে—এক, রাজা–রাজবর্গের বা ভোগবাদী সমাজের মানুষের রাজকীয় সাজানো–গোছানো ভোগবাদী প্রেম; দ্বিতীয়টি হলো দুঃখী মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত মগজ আর হৃদয় পোড়ানো মানুষের টিকে থাকার প্রেম। বিষয়টা অনেকটা আমাদের আদি দুই কবি, রাজার আলয়ে রাজকীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকা বিদ্যাপতি আর দুঃখের আলয়ে ল্যাম্প জ্বালিয়ে রাখা দুঃখী কবি চণ্ডীদাসের প্রেমের কবিতার মতো। পাঠক হয়ে আমরা যখন পড়ি, দুজনকে দুরকমভাবে ভালো লাগে। তবে মন যেন একটু বেশি পড়ে থাকে চণ্ডীদাসের দহনের জন্য। কাজী জহির আর চিত্রা জহির দম্পতির প্রেমের ছবিও এই দ্বিতীয় প্রকৃতির।

সেই ছবিতে ধনী বা বিত্তবান ঘরের প্রতিনিধি থাকলেও প্রেমের গল্প কিন্তু অর্থবিত্ত-প্রতিপত্তি, ধর্ম-বর্ণ-জাত—সবকিছু ছাপিয়ে গিয়ে একটা দুঃখের রাতের তিমির দীপশিখা জ্বালিয়ে রাখে। ‘নতুন বউ’ চলচ্চিত্রটিও সে ধরনের একটি কাহিনি। এই চলচ্চিত্রের পরিচালক যদিও কাজী জহির নন। কাহিনি, চিত্রনাট্য তাঁর আর প্রযোজনা করেছেন চিত্রা জহির। ১৯৮৩ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবির পরিচালক আবদুল লতিফ বাচ্চু। সৃজনশীল দম্পতির পরিবারে এমন যোগ্য সৃজনশীল বন্ধু থাকাও জরুরি। এতে তাঁরা একে অন্যের সৃষ্টিকে পারস্পরিক হৃদয়গ্রাহী বোঝাপড়ার মাধ্যমে নিত্যনতুন রূপ দিতে পারেন।

১৯৮৩ সালে নির্মিত ‘নতুন বউ’ চলচ্চিত্রটির কাহিনির মধ্যে কিন্তু জহির আর চিত্রার ১৯৭২ সালে নির্মিত ‘অবুঝ মন’ ছবির কাহিনির কিছুটা ছায়া আছে। সেই ছবিতে রাজ্জাক-শাবানা প্রেমিক জুটির একটি ট্রেনযাত্রার মধ্য দিয়ে প্রেম হয়, পরিচয় হয় এবং সেই পরিচয়ে জীবন জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ‘নতুন বউ’ চলচ্চিত্রে জাহাজে ভ্রমণের মাধ্যমে ববিতা-আফজাল হোসেন জুটির খুনসুটি উঠে এসেছে।

একইভাবে এই ভ্রমণ আলাপ থেকে পরিচয় জীবনের গতিপথ পাল্টে দেয়। ‘অবুঝ মন’ চলচ্চিত্রে রাজ্জাক ছিলেন তরুণ চিকিৎসক, ‘নতুন বউ’ চলচ্চিত্রে আফজাল হোসেনও একজন তরুণ চিকিৎসক। ববিতা-আফজালের পরিচয় থেকে ধীরে ধীরে প্রেম পর্ব যখন জমে ওঠে, তখন দূত হিসেবে অন্য এক ডাক্তারি ফেল করা বন্ধু টেলি সামাদ রিকশাওয়ালা সেজে ববিতাকে চলতি পথে রিকশায় তুলে নেন। চলতে চলতে বিড়ি ধরানোর নাম করে একটু থেমে গিয়ে প্রেমিক বন্ধু আফজালকে খুঁজে বেড়ান এবং খুঁজে পেয়ে দুই প্রেমের পাগল মিলে সদ্য মন দিয়ে বসা প্রেমিকাকে পার্কে নিয়ে যান। সেই পার্কে মান-অভিমানে প্রণয় গাঢ় হওয়ার দৃশ্যে সুন্দর একটি গান আছে, ‘ও ডাক্তার, হৃদয়ের অ্যানাটমি করতে শেখো/ তারপরে ভালো করে রোগী দেখো...’। আহমদ জামান চৌধুরীর রচনায় রুনা লায়লার কণ্ঠে এ গানটি হৃদয়ে দোলা দেয়। গানের চিত্রায়ণে ববিতাকেও দারুণ সুন্দর দেখায়।

ববিতা-আফজালের মিলন অবশ্য হয়নি। ঠিক যেভাবে ‘অবুঝ মন’ চলচ্চিত্রেও রাজ্জাক-শাবানার মিলন হয়নি। কারণ, কাহিনিতে টুইস্ট আছে। ববিতার বাবা যাঁদের চাকরি করতেন, সেই বিত্তবানের একমাত্র সন্তানের ভালো লেগে যায় ববিতাকে। এ চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদকে একেবারে নতুনরূপে পেলাম। আসাদের হাসি, চরিত্র অনুযায়ী আভিজাত্যবোধ, গাম্ভীর্য, মন বুঝে চলার ক্ষমতা—সবই অন্য মাত্রায় পৌঁছায়। বাবাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে, আফজালকে বিলেতে ডাক্তারির বড় ডিগ্রি নিতে যাওয়ার আগে কথা দিয়েও ববিতাকে আসাদকে বিয়ে করতে হয়। ঠিক যেভাবে ‘অবুঝ মন’ চলচ্চিত্রে শাবানা রাজ্জাককে বিয়ে না করে তাঁর বন্ধুকে বিয়ে করেন।

আফজাল বিলেত থেকে ফিরে এসে সবকিছু জেনে প্রেমের দহন আঘাতে দেবদাস হয়ে যান। এই চরিত্রেও আফজাল দারুণ মানিয়ে নেন। নিরুপায় হয়ে তাঁর মা, বাড়ির দীর্ঘদিনের বয়স্ক পরিচারকের গ্রামীণ কন্যাকে ছেলের বউ হিসেবে ঘরে তুলে আনেন। নতুন বউ চরিত্রে সুবর্ণা মুস্তাফা। এই চলচ্চিত্রে সুবর্ণার অভিনয় চিরকাল মনে থাকবে। কিছু কিছু দৃশ্যে তাঁকে দেখতে অবিকল বলিউডের কিংবদন্তি অভিনেত্রী রেখার মতো মনে হচ্ছিল। আবার কখনো কখনো সুবর্ণা একেবারে সুবর্ণা হয়ে উঠে এসে ভুবন আলোকিত করেছেন। তাঁর চাহনি ও হাসি—দুটোর মধ্যেই অসম্ভব রকমের মায়া খেলা করে। ববিতা যদি এই চলচ্চিত্রের প্রতিমা হন, সুবর্ণা তবে অলংকার। আর সুবর্ণা যদি রক্তমাংসের বাংলার মাটির কন্যা হন, ববিতা তবে নূপুরের ধ্বনি। দুজনে মিলেই মাটি আর জলের পাশাপাশি বয়ে চলা।

গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘ও পদ্মা নদী একটু যদি সদয় হতো…’ এবং ‘আমি কপালে পরেছি স্বামীর সোহাগের চন্দন...’ গান দুটিও মন ভালো করে দেয়। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী ও সাবিনা ইয়াসমীন। ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন আজাদ রহমান।

প্রেম-ভালোবাসা-বন্ধুত্ব, রক্তমাংসের সম্পর্কের এবং মনোজগতের উথালপাতালের অ্যানাটমি করে দেখায় ‘নতুন বউ’। এসব ছবি কোনো দিন পুরোনো হয় না।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত