টিউশন শেষ করে ডিসি হিলের পাশের রাস্তা ধরে হাঁটছি। ক্যাথেড্রালের ফটকের মুখে হঠাৎ চোখে পড়ল একটা বিজ্ঞাপন। আশি–ঊর্ধ্ব এক বৃদ্ধের সুস্থতা চেয়ে প্রার্থনার আবেদন জানানো হয়েছে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন ক্যাথেড্রালের প্রধান ধর্মগুরু। আবার হাঁটা শুরু করলাম। কয়েক কদম যেতেই মনে পড়ল, বছরখানেক আগের এক ঘটনার কথা।
তখন ক্যাম্পাসে শীতকালীন ছুটি। বাসায় চলে এসেছি। আজিজ ভাইয়ের সঙ্গে বেড়াতে যাই পাশের একটি জেলা শহরে। আমাদের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। আমাদের গন্তব্য একটি পুরাতন জমিদারবাড়ি। খেয়াল করলাম, সেখানে যাওয়ার পর থেকেই ক্যাথেড্রাল আর হাউসগুলোয় আজিজ ভাই কাউকে খুঁজছেন। জিজ্ঞেস করলে জানান, এই শহরে যখন পড়াশোনা করতেন, তখন তাঁর সঙ্গে এক খ্রিষ্টান পাদরির সুসম্পর্ক ছিল। তাঁকেই খুঁজছেন তিনি।
এক হাউসে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ফাদার এখানে থাকেন না আর। সম্ভাব্য একটি জায়গার নাম বলে দিল এক ব্যক্তি। আজিজ ভাইকে দেখলাম, সেই ঠিকানা খুঁজতে বেশ উৎফুল্ল।
দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে পৌঁছলাম হাসপাতালে। দুজন একসঙ্গে মুখোমুখি হলাম ফাদারের। ফাদার মৃত্যুশয্যায়। কথা বলতে পারছেন না। আজিজ ভাইকে দেখে পলকহীন তাকিয়ে রইলেন।
জমিদারবাড়িতে ঘোরাঘুরি শেষ করতেই বিকেল হয়ে যায়। ফেরার কথা ভাবছি। হুট করে ভাই বললেন, ‘চল, ওই ঠিকানায় ঘুরে আসি।’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলাম। একটা লোকাল বাসে চেপে বসি। হাতে টাকাপয়সা সীমিত, ফোনের চার্জও শেষের দিকে। ঘণ্টাখানেক পর খেয়াল করলাম, বাস টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের বনের ভেতর দিয়ে চলা শুরু করেছে। কিছুটা ভয় আর চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। আরও প্রায় আধা ঘণ্টা পর বাস থেকে নামলাম। আশপাশের মানুষের কাছে ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে কেউ খোঁজ দিতে পারল না। আজিজ ভাইকে বললাম, ‘চলেন বাসায় ফিরে যাই।’ আমার কথায় পাত্তাই দিলেন না। কিছু দূর যাওয়ার পর এক বৃদ্ধ ভ্যানচালক জানাল, এই জায়গা তো অনেক দূরে, এলাকাটাও দুর্গম। ভাইকে বললাম, ‘এ রকম পাগলামির কোনো মানে হয় না। চলেন, ফিরে যাই।’ ভাই রাজি হলেন না। অগত্যা ওনার পিছু নিতে হলো।
অটোরিকশা নিলাম একটা। স্কুলপড়ুয়া কিছু আদিবাসী ছেলেমেয়ে উঠল আমাদের সঙ্গে। গন্তব্য সোনারবাইদ। প্রত্যন্ত গ্রাম। পুরো এলাকায় উপজাতির সংখ্যাধিক্য। উঁচু–নিচু টিলা, মাঝেমধ্যে খ্রিষ্টানদের মিশনারি বা গির্জা দেখা যাচ্ছে। কিছুটা বিরক্তি আর উৎকণ্ঠা নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা নেমে এল।
একটা খ্রিষ্টান মিশনারি প্রার্থনালয়ের সামনে অটোরিকশা থেকে নামলাম। পাশেই মিশনারি হাউস। ভাইয়ের চোখেমুখে চাপা উত্তেজনা। হাউসের ভেতরটা সাজানো–গোছানো, সন্ধ্যাবাতি জ্বলছে। প্রবেশমুখেই এক দর্শনার্থীর সঙ্গে দেখা। তিনি দুই দিন আগে এসেছেন ফাদারের খোঁজে। ফাদার আপাতত কিছু কাজে অন্যত্র অবস্থান করছেন। ভাইয়ের মুখটা হতাশায় ভরে গেল। আমাদের দীর্ঘ যাত্রা সেবার অসমাপ্ত থেকে যায়।
বাসায় যখন ফিরি, রাত সাড়ে দশটা। আজিজ ভাইকে অবশ্য এই পাগলামির কারণ জিজ্ঞেস করা হয়নি। বাসায় ফিরেই ফোন করলাম ওনাকে। তিনি প্রথমেই জানালেন যে ফাদার হিউম অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। মিশনারি হাউসের একজন ফোন করে জানিয়েছে।
দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে পৌঁছলাম হাসপাতালে। দুজন একসঙ্গে মুখোমুখি হলাম ফাদারের। ফাদার মৃত্যুশয্যায়। কথা বলতে পারছেন না। আজিজ ভাইকে দেখে পলকহীন তাকিয়ে রইলেন। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল দুফোঁটা পানি। এমন সময় নার্স এসে আমাদের বাইরে যেতে বলল।
হাসপাতালের কেবিনের সামনে চেয়ারে গিয়ে বসলাম। আজিজ ভাইয়ের মন বিষণ্ন। স্থির করলাম, এখনই সেই পাগলামির কারণটা জানতেই হবে। জিজ্ঞেস করতেই একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বলা শুরু করলেন—
‘যখন ওই শহরে পড়তাম, এক জার্মান সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে পরিচয়। তার প্রেমে পড়ি। নাম অ্যানিয়েল্লা। সেই তরুণী বাংলাদেশে এসেছিল একটি এনজিওতে ইন্টার্নি করতে। শহরে ফাদার ও অ্যানিয়েল্লার সঙ্গে অনেক সুন্দর মুহূর্ত কেটেছে। আড্ডা হতো, তর্ক-বিতর্ক হতো। বন্ধুত্বের সম্পর্ক চমৎকার হলেও আমাদের মতাদর্শগত কিছু অমিল ছিল। সেগুলো ছাপিয়ে অ্যানিয়েল্লার সঙ্গে বন্ধুত্ব কিছুদিন পরই প্রেমে রূপ নেয়। তখন ফাদার ফিউমের অনুপস্থিতিতেও দেখা করতাম। একান্ত সময় কাটাতাম। অল্প কিছুদিনেই আমাদের সম্পর্ক অনেক গভীরে চলে যায়। মাস চারেক পর একদিন অ্যানিয়েল্লার গর্ভধারণের বিষয়টা জানতে পারি। ফাদারও এ কথা জেনে যান। সেদিন তাঁকে বেশ চিন্তিত মনে হয়েছিল।
সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা। একদিন হঠাৎ সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিজ দেশে পাড়ি জমায় অ্যানিয়েল্লা। তখন আমি জাতীয় পরিচয়পত্রসংক্রান্ত একটা কাজে গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। এ কারণে কিছুই জানতে পারিনি। পরে শহরে ফিরে গিয়ে ফাদার বা অ্যানিয়েল্লা কারোরই খোঁজ পাইনি। জার্মানির কোনো ঠিকানা বা যোগাযোগের মাধ্যমও ছিল না। এর পর থেকেই ফাদার হিউমকে হন্যে হয়ে খুঁজছি।’ টানা বলার পর থামলেন আজিজ ভাই।
অ্যানিয়েল্লার এভাবে হঠাৎ চলে যাওয়াটা ভাই মেনে নিতে পারেননি। তাঁর মনে হয়েছিল, হয়তো ফাদার কিছু জেনে থাকতে পারেন। সে জন্যই এভাবে ছুটে চলা।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা