নাটের গুরু

অলংকরণ: তুলি

দরজা খোলার শব্দ হলেও শিলা উঠল না। জানে এ সময় জামি আসবে। সে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে মোবাইল নিয়ে। জামি ওকে কী যেন বলল, শিলার সব মনোযোগ ফোনে, তাই শুনতে পায়নি। কিছুক্ষণ পর আচমকা মোবাইলটা হাত থেকে কেড়ে নিল জামি। দড়াম করে রাখল টেবিলে।
—তোমার একটা সংসার আছে, এটা কেন ভুলে যাও?
—না, আমি ভুলিনি। তোমার মতো রোবটের সংসারে আছি, এটা ভুলে যাওয়া অনেক কঠিন। এভাবে কেউ হাত থেকে কিছু নেয়?
—কতক্ষণ হলো এসেছি। কথা বলছি, তুমি শুনতেই পাচ্ছ না।
—তুমি কী বলবে আমি জানি। টেবিলে সব রেডি করা আছে।

ঝগড়া দিয়েই বিকেলটা শুরু হয় তাদের। জামি একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। সারা দিন অফিস নিয়েই ব্যস্ত। বাড়ি ফিরলেও অফিসের একগাদা কাজ নিয়ে আসে। সারা দিন একা একা শিলার সময় কাটে না। তাই মোবাইল ব্যবহার শুরু করল।
কবিতা লেখা শুরু করেছে সে। মোবাইলে বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে জানতে পারল পত্রিকায় লেখা পাঠানো যায়। হঠাৎ একদিন পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশ হতেই নেশার মতো হয়ে গেল। পত্রিকার মেইলে লেখা পাঠিয়ে সেটা ছাপা হলো কি না, তার অপেক্ষায় দিন কাটে। অনেক লেখকের সঙ্গে পরিচয় হলো। শিলা দেখল এ এক বিশাল রাজ্য। এখন সময় কীভাবে চলে যায় সে টেরই পায় না। কিছু বিড়ম্বনাও আছে।
আজ একজন লেখক একটা পত্রিকার মেইল অ্যাড্রেস চাইল। শিলা ওই ব্যক্তির ফেসবুক প্রোফাইল ঘুরে দেখল, সে প্রচুর গল্প লেখে। সে ভাবল লেখকের কাছে লেখাবিষয়ক হেল্প চাইবে। কিন্তু লেখক মশাই বড় ব্যস্ত, নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে আর মেসেঞ্জারে আসে না। এমনকি শিলা যে তাকে মেইল অ্যাড্রেস দিল, একটা ধন্যবাদও দেয়নি। ভার্চ্যুয়াল জগৎ হয়তো এমনই।

শিলার মনে হলো সংসারে মন দেওয়া উচিত। জামি একা একা খাবার খাচ্ছে। শিলা গিয়ে তার পাশে বসল। হাঁ করে খেতে চাইল। জামি পাত্তা দিল না। প্লেটের দিকে তাকিয়ে নীরবে খেতে লাগল। স্বামীর এই উদাসীনতা শিলাকে ভার্চ্যুয়াল জগতে ঠেলে দিয়েছে। স্ত্রীর যে একটা মন আছে, সেটা জামি বুঝতে চায় না। এত পড়াশোনা করেও চাকরি করার অনুমতি সে পায়নি। অভিমান আর অভিযোগেও কোনো লাভ হয়নি। তাই সে এখন রুটিনবাঁধা কাজ আর মোবাইল নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকে।

ওদিকে মহাবিরক্তিতে খেতে বসে জামি ভাবল, সে আর তার প্রতি অবহেলা সহ্য করবে না। ইদানীং রাতেও শিলা মোবাইল হাতে বসে থাকে। জামি সারা দিন কাজ করে ফেরে, কোথায় তার যত্ন নেবে তা না, সে লেখক হওয়ার বাসনায় আছে। পাশে বসে শিলা তাকে আরেক পিস মাছ দিতে চাইল। খাওয়া শেষ, তুমি এখন এলে মাছ দিতে, রেগে গিয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল জামি। দ্রুত বেডরুমে গিয়ে চিৎকার করে শিলার মোবাইলটা খুঁজতে লাগল। কোথায় সেই নাটের গুরু! আজ তাকে ভেঙে তবেই সে শান্তি পাবে।
শিলা রান্নাঘরের বারান্দায় গিয়ে হাসছে। মেজাজ দেখে আগেই মোবাইলটা চালের ড্রামে লুকিয়ে রেখেছে। ঠিক করল তার সামনে আর ফোন চালাবে না। সংসারে একটু শান্তি ফিরুক।