যৌবনের মাদকাসক্তির তীব্র অসুখ এবং নিবিড় পরম অতল আবেগপ্রবণ ভালোবাসা, ভালোবাসার সুশ্রূষা, উল্টো পিঠের হিংসা-প্রতিহিংসাজুড়ে টানটান একটি ওয়েব চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন গুণী পরিচালক রায়হান রাফী। গল্পের সংবেদনশীল মোচড় যেমন আছে, নির্মাণের দক্ষ শৈল্পিক বুনন আছে, দুর্দান্ত সব চরিত্রের অভিনয় ছবিকে বাস্তবের বিশ্বাসযোগ্য জায়গায় পৌঁছে দেয়। এখানে সব চরিত্র কাল্পনিক নয়, কল্পনা শুধু বাস্তবকে সুন্দর প্রতিস্থাপন করেছে মাত্র।
প্রেমিক জুটি সিয়াম ও বুবলী এবং সোহেল ও নীলাঞ্জনার মাখো মাখো গহিন প্রেম, প্রাণ উথালপাথাল করা প্রেমের দৃশ্য মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়। চোখের ও হৃদয়ের একূল–অকূল ভাসিয়ে আরাম নামিয়ে আনে। নেশাখোর একজন মাতালও আদর খোঁজে, সিগারেটের টানের মতো চুম্বন খোঁজে, প্রেমিকাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, পায়ে ঝাপ্টে ধরে ভালো হয়ে যেতে চায়। অশ্লীল ম্যাগাজিনের ছবি তার আর প্রয়োজন হয় না, যদি নিজের সম্মুখে আয়নায় সাক্ষাৎ নিজের রক্ত–মাংসের প্রেয়সীকে দেখতে পায়। হয়তো কিছুটা চলতি ভাষায় নাটক বা নাটকীয়তা থাকে, কিন্তু এ নাটকও আবেগবর্জিত নয়।
তথাকথিত মাতাল, লম্পটদের সবাই যখন এড়িয়ে যেতে চায়, দুর্দান্ত সাহসী এক প্রেমিকা, উল্টে প্রাণে জড়িয়ে পরম সোহাগের শুশ্রূষা দিয়ে, বিচ্ছিন্ন পথ থেকে হৃদয়যোগে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে চায়। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বুবলী শুধু মাতাল প্রেমিককে ফিরিয়ে আনার যুদ্ধে নয়, গোটা ছবিকে ধরে রাখার যুদ্ধেও অবতীর্ণ হয়ে ওঠেন। সমাজের ঘরে–বাইরে নিয়ত যুদ্ধ করা একলা নারীদের তিনি প্রতিনিধি, গল্পের বাঁকে ছন্নছাড়া প্রেমিককে ফিরিয়ে আনার রাস্তায় তাকে নিজের যুদ্ধে, জীবনের কাছে পর্যন্ত হেরে যেতে হয়। এই সুন্দরী, দক্ষ শিল্পী নায়িকার অভিনয়ের জোরে ছবি উত্তীর্ণ হয়ে যায়। বুবলীর জন্য মন কাঁদে, প্রাণ কাঁদে।
এমন অসাধারণ প্রেমের দৃশ্য, নরম কোমল দুঃখ বেদনাজারিত প্রেমের গান, সুরের আবহ থাকলেও এই ছবি শেষ পর্যন্ত প্রেমের ছবি হয়ে থাকে না। প্রেমের উল্টো পিঠের প্রতিহিংসা, খুন, হানাহানি, জীবনের চরম বিপর্যয়—এমন মোচড় দিয়ে যায় যে বিধ্বস্ত সিয়ামকে গভীর সত্যের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে এই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফেরার কোনো পথও আর থাকে না। যেভাবে নেশার জন্য অস্থির, কাতর মুহূর্তগুলো প্রতিনিয়ত তাকে ঝড়ের মুখে ঠেলে দেয়। যেকোনো প্রকারে মাদক জোগাড়ের পর মৃত্যুর মুখ ছুঁয়ে ভিন্ন জগতের প্রশান্তি নেমে আসে। নেশার পরিণতি এতটাই ভয়ংকর, একমাত্র অন্তিম ঘুমের দেশ শেষ ঠিকানায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বখাটে মাদক আসক্ত সিয়ামের অভিনয় অনবদ্য, অসাধারণ। তার চুলে ঢাকা মুখের মতোই সুন্দর। মাদক নেশা যে কতটা সর্বনাশা, পরিচালক আমাদের চারপাশের জনজীবনের সেই ছবিই তুলে এনেছেন।
যৌবন মাত্রই তীব্র আবেগ, প্রেম বেদনা, হতাশা বিষণ্ণতায় ভরপুর। জীবনের এই তুমুল ঝড়–তুফানের দোলাচলের মূল সময়ে অনেকেই নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে মাদক নেশায় জড়িয়ে পড়ে। এই সময়টাতে আবার যেহেতু অনেকেই বেকার থাকে, নেশার খোরাক জোগাতে চুরি, ছিনতাই পর্যন্ত করতে বাধে না। একবার যারা নেশা ধরে ফেলে; মস্তানি, অপরাধজগৎ, রাজনৈতিক নেতা, অপরাধজগতের সমাজবিরোধীদের হাতের ঘুঁটি হয়ে যেতে হয়। ভবিষ্যতের পথ অন্ধকার হয়ে যায়।
রায়হান রাফী বর্তমান সময়ের পরিচালক, যৌবনের মনের আলো-অন্ধকার এবং মাদকাসক্তদের খুঁটিনাটি সব দিক নিপুণভাবে তুলে আনতে পেরেছেন। গল্প ও চিত্রনাট্যর কিছু ত্রুটি আছে। সীমিত পরিসরে এত বড় ঘটনার ঘনঘটাসংবলিত একটি কাহিনি ধরে রাখাও সহজ কাজ নয়। হিংসার দৃশ্যগুলোর মাত্রা অতিরিক্ত প্রকট হয়ে ওঠে। কাহিনির গভীরতা বোঝাতে এই মাত্রাতিরিক্ত হিংসার দৃশ্য প্রতিটি রোমকূপে কাঁটা দিয়ে ওঠে। যার কারণে প্রেমের রেশ নরম কোমল অনুভূতি শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে আসে। দুঃখ, বেদনায় ভারাক্রান্ত করে তোলে।
নীলাঞ্জনা নীলার অবশ-অসার হয়ে ওঠা চরিত্রটিও অসাধারণ। সত্যের মুখ উন্মোচনে প্রবল ভূমিকা রাখে। প্রেম থেকে প্রতিহিংসার এই যাত্রায় সোহেল মন্ডলও অনন্য। রায়হান রাফীর ছবিতে যেভাবে একেবারে একালের সময়ের আন্তরিক, প্রাণবন্ত গান এবং সুর ব্যবহার করা হয়, আমাদের সময়ের সরাসরি কবিতা ব্যবহারেরও একটা সুযোগ আছে। পরিচালক দৃশ্য বুনোনের সময় মাথায় রাখতে পারেন। তাতে করে সময় এবং সময়ের কুশীলবদের আবেগ, অনুভূতিকে আরও বিস্তীর্ণ পরিসরে ধরা যেতে পারে। আমাদের এই সময়ে গতিশীল জীবনে সবাই যেহেতু অনবরত ছুটছে, ছবির ভাষাও গতিশীল ছুটে চলার দৌড়াদৌড়িতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে একটু মন্থর গতির ভাষা বা দৃশ্য তুলে আনার চেষ্টা করলেও খারাপ লাগবে না।
সমাজে মানসিক ও সামাজিক সমস্যা যেমন রয়েছে, সেই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার চিকিৎসাবিদ্যাও রয়েছে। মাদক আসক্ত বা সমাজবিরোধী বিচ্ছিন্ন হয়ে ওঠা মানুষকে মূল স্রোতে ফেরাতে মনের ডাক্তারেরা নিয়মিত কাজ করেন, সেই বার্তাগুলোও বারবার তুলে আনা দরকার। এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয় সৃষ্টিশীল মানুষ, শিল্পী, পরিচালকদের দায়দায়িত্ব আরও বেশি। এই বিষয়গুলো তুলে আনার মধ্যে ঠিকঠাক চিত্রনাট্য সাজিয়ে তুলতে পারলে গল্পের মূল বিষয় বা গতি কোথাও আটকাবে না।
‘টান’-এর গল্প ও চলচ্চিত্রায়ণ বুকের ভেতরে টান দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। মানুষের মন নিয়ে এই টানাটানির সৃজনশীলতা, পরীক্ষা–নিরীক্ষা পরিচালক চালিয়ে যান। চলচ্চিত্রের অন্য সব সৃজনশীল কলাকুশলী হলেন ফারজানা ছবি, শেখ রাজিবুল ইসলাম, জাহিদ নীরব, রিপন নাথ, সিমিত রায় অন্তর, আদনান আল রাজীব এবং আরও অনেকে।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত