হিসাবরক্ষক বাবা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা খুব ছোট্ট ছিল। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত, ঠাকুরমা বলেছিল। দাদা মারা গিয়েছিল তার কয়েক মাস আগে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভারত থেকে যখন বাবারা বাংলাদেশে আসে, তখন কিছুদূর পড়াশোনা করার পর পড়ালেখার পাট চুকিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন বাবা। বয়স ও শারীরিক গঠন কোনোটাই বড় না হলেও বড় হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক দায়িত্ব। ছোট ছোট দুই বোন, এক ভাই ও বিধবা মায়ের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কুমিল্লা শহর থেকে নরসিংদী চলে আসেন বাবা। সম্পদ হিসেবে ওই ফাইভ পাস পর্যন্ত পড়াশোনা। দাদা মাস্টার ছিলেন। তবে কোনো স্কুলের নয়; বাড়িতে পড়াতেন। তাই বাবার পড়ালেখার ভিত্তিটা ভালো ছিল। এখনো তাঁর লেখার মতো আমাদের ভাইবোনদের কারও লেখা এত সুন্দর না।

সাংসারিক দায়িত্বের চাপে শৈশব-কৈশোর বলতে খুব বেশি স্মৃতি বাবা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করত না। শুধু বলত, ছোট থেকেই মুদিদোকানে ছিলাম। আনন্দটা ওই দোকানের মালামাল গোছানো, বিক্রি করা, ফরমাশ রক্ষার্থে এখানে–ওখানে যাওয়া—এসবেই দিন কেটে যেত। ছুটি পেলে বাড়ি যেতাম, মা অপেক্ষায় থাকত। কখনো কখনো দেশ থেকে লোক এলে মা ও ভাই-বোনদের জন্য এটা-সেটা কিনে দিতাম। সামনে কখন যাব, সেটা মাকে জানাতে বলতাম। আমি খুব ডালের বড়া পছন্দ করতাম। আগে থেকে জানালে, বাড়ি গেলে দেখতাম মা আমার পছন্দের সব খাবার তৈরি করে রেখেছে। মাঝেমধ্যে পকেটে বেশি টাকা থাকত না। যেটুকু পারতাম গাড়িতে করে যেতাম। বাকিটুকু মাটির রাস্তা, খেতের আল ধরে হেঁটে চলে যেতাম। আর বাড়ি গেলে মা বকাবকি করত আর বলত, ‘আমাদের জন্য এত কিছু না এনে বাস থেকে নেমে একটা রিকশা করে চলে আসতে পারতি। মাকে বোঝাতে পারতাম না, রিকশা এত দূর আসে না। মাটির রাস্তা বলে আর ছোট ভাই–বোনদের জন্য খেলনা, মিষ্টি-সন্দেশ নিলে এরা যা খুশি হতো, এগুলো দেখেই আমার আনন্দ লাগত।’

ছোটবেলায় যখন ভাইবোনদের কারও জ্বর হতো, বাবা রাতে বাড়ি ফেরার সময় নাবিস্কো রুটির প্যাকেট আর মিষ্টির দোকান থেকে রসমালাই নিয়ে আসত। তাই ছোটবেলায় জ্বর হলে আমরা খুব খুশি হতাম।

বাবা এগুলো খুব একটা বেশি বলত না। মাঝেমধ্যে আমরা ভাইবোনেরা বাবাকে অনুরোধ করলে বাবা বলত। তা ছাড়া ঠাকুরমা এগুলো গল্পের ছলে আমাদের সঙ্গে বলত। আজ ঠাকুরমা নেই। কিন্তু মাথার মধ্যে ওই গল্পগুলোই স্মৃতি হিসেবে থেকে গেছে। নরসিংদী শহরে বাবার এক পিসতুতো বোনের বিয়ে হয়েছিল, তাঁর নাম ছিল সন্ধ্যা। আমরা তাঁকে সন্ধ্যা পিসি বলে ডাকতাম। এই পিসিও বাবাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন, বুঝ হওয়া পর্যন্ত আমরা দেখেছি। মাঝেমধ্যে অনেক কিছু নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতেন। বাবাকে বাড়িতে পেলে নিজে বসে থেকে খাইয়ে দিতেন।

ছোটবেলায় যখন ভাইবোনদের কারও জ্বর হতো, বাবা রাতে বাড়ি ফেরার সময় নাবিস্কো রুটির প্যাকেট আর মিষ্টির দোকান থেকে রসমালাই নিয়ে আসত। তাই ছোটবেলায় জ্বর হলে আমরা খুব খুশি হতাম। এখনো মাঝেমধ্যে জ্বর হয়; কিন্তু বাবা আর রাতে বাড়ি ফেরার সময় রুটি আর রসমালাই নিয়ে আসেন না। আমরা বড় হয়ে গেছি, বাবার স্মরণশক্তিও কমেছে। তবু তিনি এখনো বাড়ি ফেরার সময় অনেক কিছু নিয়ে আসেন। হয়তো সেগুলো নাতি-নাতনিদের জন্য; কিন্তু তাতে আমাদেরও ভাগ থাকে।

ছোটবেলায় বৃত্তি পরীক্ষার সময় বাবাকে সঙ্গে যাওয়ার জন্য মর্জি করতাম। দূরের স্কুলে বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময় যখন দেখতাম অনেকের বাবা-মা সঙ্গে যেত, আর আমি যেতাম একা অথবা শুধু মায়ের সঙ্গে; তখন বাড়িতে এসে কান্নাকাটি করতাম। বাবা সকাল সকাল কাজে চলে যেত আর ফিরত রাতে। এর মধ্যে দুপুরে আসতেন খাবার খেতে। মালিক খুব কড়া ছিল, তাই চাইলেও বেশি সময় বাড়িতে থাকতে পারতেন না। তবু বাবা একবার ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষার সময় একদিন সকালে দিয়ে এসেছিল, শুধু আমার কান্নাকাটি আর মর্জি রক্ষার্থে। সেদিন যে কত খুশি হয়েছিলাম, এখনো সে স্মৃতি মনে আছে। বাবা একটা সাদা রঙের রেক দেওয়া শার্ট ও বাদামি রঙের প্যান্ট পরে ছিলেন। যদিও দোকানে গিয়ে কথা শুনতে হবে বলে বাবার মেজাজ খারাপ ছিল, তবু আমার মর্জির কাছে বাবাকে হার মানতে হয়েছিল সেদিন।

আমার বাবা একজন হিসাবরক্ষক। স্থানীয় দোকানগুলোয় যাদের বলা হয় সরকার। মুদিদোকানে থাকতে থাকতে বাবা হিসাব রাখাটাও ভালোভাবে আয়ত্ত করেছিল। যে আয়ে আমাদের সংসার চলত, এখনো চলে। এখনো বাবার কাছ থেকে সংসারের দায়িত্বটা নিতে পারিনি। বাবার বয়স বাড়ছে, কিন্তু আমরা এখনো ছোট রয়ে গেছি।
বাবাকে এই সাংসারিক দায়িত্ব থেকে কয়েক দিনের জন্য মুক্তি দিয়ে বিশ্বভ্রমণে পাঠানোর ইচ্ছে আছে মায়ের সঙ্গে। কথাটা বাবাকে বলার সাহস হয় না। হয়তো এমন স্বপ্নের দিন একদিন আসবে, সেই অপেক্ষায় রইলাম।

বন্ধু, নরসিংদী বন্ধুসভা