আশায় বাঁচে ভালোবাসা, ভাসায় পুরো জীবন

অলংকরণ: তুলি

আহমাদ আমার কলেজজীবনের বন্ধু। একই রুমে দুবছর ছিলাম। আমি ও আহমাদসহ মোট পাঁচজন বন্ধু থাকতাম একটা ছাত্র হোস্টেলে; সবাই সমবয়সী হওয়ায় সময়গুলো বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

তখন যুগটা ছিল বাটন ফোনের। এখনকার মতো অডিও বা ভিডিও কলে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আহমাদ আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হওয়ায় তাঁর অনেক কিছুই জানার সুযোগ হতো। একবার খেয়াল করলাম, প্রতিদিন পড়াশোনা শেষে রাতে যখন বিছানায় ঘুমাতে যাই, তখন সে বারান্দায় গিয়ে ফোনে কথা বলে। মাঝেমধ্যে রাত তিন-চারটায় ঘুম ভেঙে যেত। তখনো বারান্দা থেকে ফিসফিস শব্দ শুনতাম।

কিছুদিন পর তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কার সঙ্গে কথা বলে? সে কিছুতেই বলতে রাজি না। অনেক জেরাজুরির পর বলল, একজনের সঙ্গে। কে সে, তা আর বলে না। আমারও আগ্রহ বেড়ে গেল! তাই কয়েক দিন ঘুমের অভিনয় করে বন্ধুর কথা শোনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে এতটাই আস্তে কথা বলে যে কিছুই বুঝতে পারিনি। এভাবে কলেজজীবনের প্রায় এক বছর চলে গেল। হঠাৎ একদিন দেখি আহমাদ মন খারাপ করে বসে আছে। কারণ জিজ্ঞেস করায় কিছু না বলে উড়িয়ে দিল। বুঝলাম শেয়ার করতে চাচ্ছে না। আমিও আর কথা বাড়াইনি। তিন-চার দিন পর দেখলাম বন্ধুর মন এখনো খারাপ। রাত জেগেও আর কথা বলছে না। এবার একরকম জোর করেই তার কাছ থেকে কথা বের করে আনি। তার আগে শর্ত দিল আমি যেন অন্য কারও সঙ্গে এগুলো শেয়ার না করি। রাজি হলাম।

মেয়েটির নাম আভা, সুন্দরী এবং পড়াশোনায়ও অনেক ভালো। বাবা শিল্পপতি, শহরে বেড়ে ওঠা। আমাদের কলেজে পড়ে, একই বিভাগ ও ব্যাচের শিক্ষার্থী। আহমাদের মন খারাপের কারণ, সে আভাকে চিনে কথা বললেও মেয়েটি তাকে চেনে না। নিজের পরিচয়ও অন্যটা দিয়েছে। তাদের কখনো দেখা হয়নি। শুধু ফোনেই কথা বলে গেছে দীর্ঘদিন। এখন আভা দেখা করার জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। প্রতিবার নানা অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আহমাদ ক্লাসের পেছনের বেঞ্চের শিক্ষার্থী। গ্রামের সাধারণ ছেলে, মেসে থেকে পড়াশোনা করে। তবে সে কথা বলায় বেশ দক্ষ। আভার কাছে নিজের সত্যি পরিচয় দেয়নি মূলত এ কারণেই। দেখা হলে যদি তাকে না করে দেয়!

আমার বন্ধুটি এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছে যে এখন দেখা না করলেও তার সঙ্গে আভা কথা বলবে না, আবার দেখা করলেও কথা বলা বন্ধ করে দিতে পারে কিংবা তাকে পছন্দ না–ও করতে পারে। এমন অবস্থায় সে কী করবে বুঝতে পারছে না। তাই মন খারাপ। সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি বললাম, ‘যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন তুই দেখা না করলে আর সম্পর্ক থাকবে না; তার থেকে বরং দেখা করে সবকিছু বলে দেখ, কপালে যা আছে হবে।’ আমার কথা শুনে সে যেন একটু সাহস ফিরে পেল। কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘হ্যাঁ তাই করতে হবে; কাপুরুষের মতো লুকিয়ে হেরে যাওয়ার থেকে বীরের মতো সামনে দাঁড়িয়ে হারিয়ে ফেললেও কষ্ট থাকবে না।’ আভাকে ফোন দিয়ে বলল, ‘তোমার সঙ্গে দেখা করব। কোথায়, কখন, তুমি বলো।’

সময়টা ছিল ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের কোনো একটি দিন। আহমাদকে বলেছে পাঞ্জাবি পরে আসতে এবং আভা নিজে শাড়ি পরবে। আভা প্রথমবার নিজের প্রিয় মানুষের সঙ্গে দেখা করবে বলে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিল। ওই দিন সকাল থেকেই বারবার ফোন দিচ্ছিল। অন্যদিকে বন্ধুটি ভয়ে চিন্তিত। সাহস পাওয়ার জন্য আমাকেও সঙ্গে নিল। নির্দিষ্ট জায়গাতে সঠিক সময়েই আমরা পৌঁছালাম। এরই মধ্যে আভা ফোন দিয়ে জানাল, জ্যামে আটকা পড়েছে, আসতে আরও একটু সময় লাগবে। কিছুক্ষণ পর সে এসে ফোন দিল, আমরা দূর থেকে তাকে লক্ষ করছি। আহমাদ প্রথমে ফোন ধরেনি। আমি বললাম, ‘এইবার ফোনটা ধর, না হলে আরও বিপদ আছে।’ এরপর সে ফোন ধরে নিজের অবস্থান জানালে আভা এসে উপস্থিত হয়। আমাদের দেখে তার মুখের হাসি হঠাৎ করেই কমে যায়। বন্ধুর পাঞ্জাবি দেখে বুঝে ফেলল সে এত দিন রং নাম্বারে কার সঙ্গে কথা বলেছে।

তারা দুজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কেউ কিছু বলছে না। আমিই প্রথম নীরবতা ভাঙলাম। জিজ্ঞেস করি, আভা কেমন আছ? জবাবে বলল, ভালো। আবার পিনপন নীরবতা। এরপর তোমরা দুজন কথা বলো, আমি ওদিকে আছি বলে দূরে সরে যাই। পরের গল্পটুকু বন্ধুর কাছ থেকে শোনা।

আভার প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘তুমি এত দিন পর্যন্ত আমাকে পরিচয় না দিয়ে এমনটা করতে পারলে? তুমি এত মিথ্যাবাদী আর কাপুরষ কেন? নিজের পরিচয় দিতে এত ভয় কেন?’ জবাবে আহমাদ বলল, ‘তোমাকে হারানোর ভয়ে বলিনি, দেখাও করিনি; তুমি যদি আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দাও তার জন্য। এখন আমাকে যে শাস্তি দাও মাথা পেতে নেব; তবু আমাকে ভুল বোঝো না। আমি সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। সবকিছু মিথ্যা হলেও ভালোবাসাটা মিথ্যা নয়। ভালোবাসি বলেই তোমার সঙ্গে এত দিন মিথ্যা বলার পরও দেখা করতে এসেছি।’

‘আজকের পর থেকে কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার আগপর্যন্ত আমাকে ফোন দিতে পারবে না, আমার সঙ্গে কলেজেও কোনো কথা বলতে পারবে না, জিপিএ- ৫ পেতে হবে ফাইনাল পরীক্ষায়, কলেজে কাউকে বলতে পারবে না আমার সঙ্গে তোমার কোনো সম্পর্ক আছে, তোমার যে বন্ধুকে (আমি) নিয়ে এসেছ, সে ছাড়া অন্য কেউ যেন না জানে। সব শর্ত পূরণ হলে আরও এক বছর পর জানতে পারবে আমি তোমাকে ভালোবাসি কি না।’

দুজনের মধ্যে আরও অনেক কথা হলো। হঠাৎ আহমাদ জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?’ ‘তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো তার প্রমাণ দিতে পারলে আমি তোমাকে ভালোবাসি কি না, জানতে পারবে। আর যদি প্রমাণ করতে না পারো, তাহলে আমাকে ভুলে যেতে হবে। আমার কিছু শর্ত আছে; যেগুলো তুমি পূরণ করতে পারলে আমি বুঝব তুমি আমাকে সত্যি ভালোবাসো।’ আভার জবাব।

আমার বন্ধুর মনে হলো, সে হয়তো তাকে ভালোবাসে না। এ কারণে শর্ত দিচ্ছে। তবু শর্ত জানতে চাইল। আভা তার শর্ত বলতে শুরু করল, ‘আজকের পর থেকে কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার আগপর্যন্ত আমাকে ফোন দিতে পারবে না, আমার সঙ্গে কলেজেও কোনো কথা বলতে পারবে না, জিপিএ- ৫ পেতে হবে ফাইনাল পরীক্ষায়, কলেজে কাউকে বলতে পারবে না আমার সঙ্গে তোমার কোনো সম্পর্ক আছে, তোমার যে বন্ধুকে (আমি) নিয়ে এসেছ, সে ছাড়া অন্য কেউ যেন না জানে। সব শর্ত পূরণ হলে আরও এক বছর পর জানতে পারবে আমি তোমাকে ভালোবাসি কি না।’

শর্ত শোনার পর আহমাদের মনে হলো, আভা তাকে ভালোবাসে বলেই এমন শর্ত দিয়েছে; যেন তার নিজেরও পড়াশোনার ক্ষতি না হয়, আর আহমাদ যেন নিজেকে উপযুক্ত করে তুলতে পারে। ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আর শক্তি অনেক বেশি হয়। তা–ই যেন পরবর্তী সময়ে প্রমাণ পেলাম। এর পর থেকেই আমার বন্ধু কলেজ শেষ করে এসেই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। তাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে, আর নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। যে বন্ধুকে গত এক বছরে বই নিয়ে বসতে খুব কমই দেখেছি, সে এই ঘটনার পর পুরোপুরি পাল্টে গেল। এভাবে দেখতে দেখতে আরও এক বছর চলে গেল। তাকে আর কখনো দেখিনি ফোনে কথা বলতে। সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।

২০১৪ সাল, এইচএসসির ফল প্রকাশ পেল। আমি জিপিএ-৫ পাইনি। তবে আমার বন্ধুটি পেয়েছে। তার খুশিতে আমার কষ্টও দূর হয়ে গেল। এবার সে আভাকে ফোন দিল। দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় পর। প্রথম প্রশ্নই ছিল, ‘তোমার ভালোবাসা প্রমাণ করতে পেরেছি কি? এখন বলো তুমি আমাকে ভালোবাসা কি না?’ ‘কালকে কলেজে আসো, দেখা করে তারপর বলব।’ অপর পাশ থেকে জবাব আসে।

পরদিন কলেজে গেলাম। সবাই এসেছে। আভাও জিপিএ-৫ পেয়েছে। সবাই আনন্দ করে কলেজের মাঠে গিয়ে বসলাম। তবে আহমাদের চেহারায় আনন্দ নেই। কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট। ভালো রেজাল্ট করেও তার মন খারাপের কারণ কেবল আমি জানি। হঠাৎ আভা দাঁড়িয়ে বলল, ‘সবাই আজকের পর থেকে আলাদা হয়ে যাবে। তাই সবার উদ্দেশে আমি কিছু বলব।’ এর পরই সে আহমাদকে কাছে ডেকে নিল এবং পাশে বসিয়ে বলল, ‘আজ সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবে আহমাদ। কারণ, সে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে।’ সবাই এ কথায় সাড়া দিল। আভা বলল আরও একটা কারণ আছে। এরপরই আহমাদের হাত ধরে বলল, ‘আমি আহমাদকে ভালোবাসি।’ এ কথা শুনে সবাই চুপ। কেউই যেন প্রস্তুত ছিল না। আভা বলতে লাগল, ‘সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ থাকলে আর জীবনে কিছু লাগে না।’ সেদিন আভার কথা শুনে আহমাদ কান্না করে প্রতিজ্ঞা করেছিল, কখনো তার হাত ছেড়ে যাবে না।

অনেক বছর কেটে যায়। আহমাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে একটা সরকারি ব্যাংকে কর্মরত। অন্যদিকে আভা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে এখন একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। দীর্ঘ আট বছরের ভালোবাসার পূর্ণতা শেষে দুই বছর আগে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। এখন বেশ সুখেই আছে।

সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা