নদী দেশের জন্য আশীর্বাদ

পদ্মা নদীতে মাছশিকারি জেলেদের নৌকা। প্রতীকীছবি: হাসান মাহমুদ

‘নদী’ শব্দটি কেমন যেন জাদুকরি ও মায়াভরা। কোমল-লাবণ্যময়তায় ভরপুর। প্রাণপ্রাচুর্যের আধার। আমাদের দেশে সবার জীবনে নদীস্মৃতি রয়েছে। কেউ হয়তো নদীপাড়ের জীবনে সমৃদ্ধ, কেউ হয়তো নদীপথের জীবনে অভ্যস্ত, কেউবা কখনো কখনো নদীর কাছে গিয়েছেন। নদীর সঙ্গে আমাদের জীবনের গভীরতর সম্পর্কসূত্র বিদ্যমান। এই সম্পর্কসূত্র বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত না থেকেও আমরা নদীর প্রতি অনুরক্ত। নদী আমাদের কল্পনার সহযাত্রী। শিল্প-সাহিত্যে নদী জীবনের উপমায় জ্বলজ্বলে। নদীর প্রতি আমাদের অযুত ভালোবাসা।

প্রতিদিনই আমাদের দেশে নদী কিছুটা করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত। অশীতিপর বার্ধক্যে যাঁরা পৌঁছেছেন, তাঁদের অনেকেই স্মৃতি থেকে বলে থাকেন—এখানে একটা নদী ছিল, ওখানে ওই নদীর শাখা ছিল, এখানে এ বিলটি বর্ষায় নদীরূপ পেত; এ রকম অনেক কথাই শোনা যায়। ষড়্‌ঋতুর বাংলাদেশে এখনো বর্ষা ঋতুতে অনেক বৃষ্টি নামে। বন্যায় ভাসে দীর্ঘ জনপদ। তবু যে নদীর সংখ্যা দিনের পর দিন কমছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিহাস যতটুকু জানা যায়, প্রাচীন বাংলায় নদী ছিল সহস্রাধিক। সেই নদীর সংখ্যা বর্তমানে ৩১০ বলা হলেও এখন প্রধান কয়েকটি নদী ছাড়া আর তেমন নদী নেই বললেই চলে। নদীর সংখ্যা কমতে কমতে যে বাংলাদেশ নদীশূন্য দেশে পরিণত হতে পারে, এমন ভাবনা হয়তো আমাদের মানসপটে কখনো ভাসে অথবা ভাসে না। নদী নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের উদাসীনতা আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ের চক্রান্ত—এ দুই কারণে বাংলাদেশ কালের গর্ভে নদীশূন্য দেশ হয়ে উঠবে না, এ কথাও আমরা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারি না। আমাদের পাঠ্যপুস্তক, আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের সামাজিক কাঠামো—কোথাও নদীসচেতনতামূলক কোনো পাঠ-আলোচনা কর্মশালা হয় না। অথচ নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাণ হচ্ছে বাংলাদেশ।

দেশকে যখন আমরা মা ডাকি, তখন সেই মা ডাকের মধ্যে মাটি যেমন আমাদের মা, তেমনি নদীও আমাদের মা, তা বোধ হয় আমরা উপলব্ধি করি না। আমরা যে খাদ্যশস্য উৎপাদন করি, তার সঙ্গে নদীর রয়েছে অন্তঃশীলা সম্পর্ক। নদী বয়ে চলে যে পথে, সে পথে আমাদের কাছে শুধু উপরিতলের নদীটিই দৃশ্যমান। মাটির নিচে সেই নদী যে সজীবতা সঞ্চার করে, সে খবর আমরা জানি না। শুধু তা-ই নয়, উজান থেকে নেমে যাওয়া নদীর পানি সামুদ্রিক লবণাক্ত জলকে চাপ দিয়ে রাখে, যাতে লবণাক্ত পানি ওপরের দিকে উঠে আসতে না পারে। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে যে প্রধান নদীগুলো আছে, সে নদীগুলোর যত্ন করতে না পারলে, বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে উত্তরাঞ্চলের দৃশ্যপট নিকট ভবিষ্যতে বদলে যাবে। পদ্মা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমর, ফুলকুমরসহ উজানে ভারত থেকে নেমে আসা নদীগুলো না থাকলে দেশের ভেতরের ছোট নদীগুলোও মারা যাবে। কারণ, এ নদীগুলোর পানিই ছোট নদীগুলোর প্রাণ। করতোয়া, ধরলা, আখিরা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, টেপা, রত্নাইসহ যে ছোট নদগুলো আছে, সবই প্রাণ হারাচ্ছে। সারা দেশের ছোট নদীগুলোরও অভিন্ন বাস্তবতা।

পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে তা হবে পানি নিয়ে, এই আশঙ্কা কেউ কেউ ব্যক্ত করেছেন। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আবার হোক, এটা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি হয়, তাহলে পানি নিয়ে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে নদী দখলের হীন চেষ্টা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ-ভারত মিলে মোট ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। তার ৫৩টিরই উৎস ভারত। ভারত বাংলাদেশের উজানে থাকা তার প্রায় সব নদীর পানি প্রত্যাহার করার উদ্যোগ নিয়েছে। ভারত যদি এ কাজ শুরু করে, তাহলে বাংলাদেশের জন্য তা হবে মৃত্যুর নামান্তর। চীনও ব্রহ্মপুত্রের খাত পরিবর্তন করার কাজ করছে। এতে বাংলাদেশ-ভারত উভয় রাষ্ট্রই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে মহানন্দা নদী। এই নদীর ভারতের ফুলবাড়ী অংশে রয়েছে একটি বাঁধ। সরদারপাড়া, তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়
ছবি: হাসান মাহমুদ

আমাদের দেশে মৃত্যুপথযাত্রী প্রায় সব নদী। প্রকৃতির কোলে যখন বাংলাদেশ নির্বিঘ্ন শায়িত ছিল, রেল-সড়কপথ যখন বাংলাদেশের বুক চিরে বয়ে যায়নি, তখন কোনো নদীকে কৃত্রিম সংকট আঘাত করতে পারেনি; বরং সভ্যতা বিকাশের যে বিভিন্ন স্তর, সেখানে দেখা যায় মানুষ যখন যাযাবর জীবন ছেড়ে দিয়ে স্থানিক হয়েছে, তখন মানুষ বসবাসের জন্য বেছে নিয়েছিল নদীতীরবর্তী কোনো স্থান। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, প্রথম যোগাযোগ হিসেবে নৌপথই ছিল ভরসা। নদীতীরেই গড়ে উঠেছিল সভ্যতা। দেশে অনেক স্থানের নামের সঙ্গে ‘গঞ্জ’ যুক্ত আছে। দেশের যে স্থানগুলোর নামে গঞ্জ যুক্ত, তার সবই ছিল নদীতীরবর্তী। নৌপথে মানুষ বাণিজ্যিক কাজে যে নির্দিষ্ট এলাকায় নিয়মিত হাট বসাত, তা-ই গঞ্জ বলে খ্যাত ছিল। বর্তমানে যে গঞ্জগুলো বিদ্যমান, তার পাশ দিয়ে কখনো নদী ছিল কি না, সেই স্মৃতিচিহ্নও এখন আর নেই।

কালিক বিবর্তনে নদীপথ বাংলাদেশে উপেক্ষিত থেকেছে। সড়কপথ, রেলপথ—দুই–ই আমাদের নদীগুলোকে তার স্বাভাবিক প্রবাহের ওপর বাধা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে ব্রিটিশ শাসনামলে যখন রেলপথ বাংলাদেশে চালু হয়, তখনই নদীর ওপর দিয়ে প্রচুর রেলসেতু করা হয়। এরপর জালের মতো বিছানো সড়ক, জালের মতো ছড়ানো নদীর ওপর দিয়ে সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে সেই নদীপ্রবাহে যে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে; এতে প্রথমে যৌবনবতী অনেক নদী তার স্রোত হারাতে থাকে। ক্রমান্বয়ে প্রসারিত নদী হয়েছে ক্ষীণ এবং শেষাবধি সেই ক্ষীণ জলধারাও মিলিয়ে গেছে। যে নদীতে একদা জাহাজ ভিড়ত, সে নদীতে পরবর্তী সময়ে নৌকা ভিড়ত। অবশেষে নদীর পরিচয় নেমে আসে ‘বিল’ পর্যায়ে। অতঃপর জলহীন প্রান্তর কয়েক দশক বছরের ব্যবধানে স্মৃতিতে বেঁচে থাকে সেই নদী।

বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থায় নদীপথ হতে পারত প্রধান অবলম্বন। বাংলাদেশের আশীর্বাদ এ নদীগুলো আমরা অভিশাপ বিবেচনা করে এগুলোকে কাজে না লাগিয়ে উপেক্ষা করেছি। বিশেষ করে পণ্য পরিবহনে খুবই কম ব্যয় নৌপথে। আমাদের দেশের নদীগুলো এমনভাবে জালের মতো বিছানো যে দেশের এক অঞ্চলের পণ্য অন্য অঞ্চলে অনায়াসে নদীপথেই পরিবহন করা সম্ভব ছিল। এখনো যে সেই সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে, তা নয়। এখনো সেই সম্ভাবনা অনেকটাই রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় তৎপরতা নেই বললেই চলে। জলপথে আমাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগব্যবস্থাও অত্যন্ত সমৃদ্ধ।

বাঙালি জাতি সম্পর্কে বহুল প্রচলিত প্রবাদ ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। এই মাছের প্রধান উৎস ছিল আমাদের নদী। দেশ নদীমাতৃক হওয়ায় প্রচুর মাছ হতো। আমাদের দেশের নদীগুলোর ভগ্নদশায় মাছের প্রধান উৎস লুপ্তমুখী। এখন দেশে প্রচুর মাছ চাষ হয়। কিন্তু এই মাছে আর নদীর মাছে যে বিস্তর তফাত, বলার অপেক্ষা রাখে না। বংশপরম্পরায় অনেক জেলেকে বেছে নিতে হয়েছে ভিন্ন পেশা। নদীপাড়ের জীবনে, বিশেষত জেলেদের যে ঐতিহ্যপূর্ণ জীবন, তা–ও হারাতে বসেছে।

শহরের পাশ দিয়ে নদীপ্রবাহ না থাকলে সে শহরের সৌন্দর্য যতই হোক না কেন, তা অসম্পূর্ণ থাকে। নদী দেশের জন্য যেমন আশীর্বাদ, তেমনই শহর-জনপদের জন্যও। যে গ্রামের পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে আর যে গ্রামে নদী নেই, এ দুই গ্রামের মানুষের চিন্তাগত-সংস্কৃতিগত পার্থক্য বিদ্যমান। যদি বাংলাদেশ থেকে নদী হারিয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশ আর এমন সবুজ থাকবে না। এক শ, দু শ, তিন শ, চার শ বছর পরের প্রজন্ম পড়বে—একদা নদীমাতৃক ছিল বাংলাদেশ। নদীমাতৃক বাংলাদেশে শরতের আকাশে শান্ত নদীর ওপর শ্বেতশুভ্র মেঘ খেলা করত। সেই দৃশ্য যেকোনো বেরসিক মানুষকেও কবিমনস্ক করে তুলত। গ্রীষ্মের নদীতে থাকত স্বচ্ছ স্বল্প জল। প্রবাহ থাকত ঝিরঝিরে। বর্ষায় নদী থাকত উন্মত্ত। ভরা যৌবনা। দুই কূল প্লাবিত স্রোতে ভাঙত দুই পাড়।

একেক ঋতুতে একেক রকম তার রূপ। নদী ছিল বলে ভূমির অল্প গভীরে থাকত জলের স্তর। ফলে ভূমির উপরিতল থাকত সজীব। পাখি ফল খেয়ে কোথাও উচ্ছিষ্ট ফেললে সেখান থেকে আপনা–আপনি গাছ হতো এবং সেই গাছ অনুরূপ ফল দিত। সে মাটিকে বলা হতো সোনার চেয়ে দামি।

নদীগুলো মারা গেলে কয়েক শ বছর পরের প্রজন্ম পড়বে—জলপথে বিশ্বব্যাপী সহজ ছিল যোগাযোগ। অথচ শুধু অবহেলা আর উপেক্ষা করে একের পর এক নদীগুলোকে মেরে ফেলেছে আমাদের পূর্ব প্রজন্ম। নদীর প্রতি দায়বদ্ধ ছিল না আমাদের দেশের মানুষ ও সরকার। নদীমুখী সরকার না থাকার কারণে রাষ্ট্র নদীবান্ধব হতে পারেনি।

কয়েক শ বছর পরের প্রজন্ম আরও পড়বে—তাদের অতীত প্রজন্ম অদূরদর্শী ছিল, অযত্ন করেছে নদীর প্রতি। তারা কি আমাদের কথা ভেবে দেখেনি? কত সুন্দর ছিল আমাদের নদী-সবুজ বাংলাদেশ।

আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে নদীশূন্য বাংলাদেশের ভয়াবহতার মুখোমুখি না হয়, আমরা যে রকম বাংলাদেশ জন্মের সময় পেয়েছি, তার চেয়েও যেন ভালো স্বদেশ রেখে যেতে পারি, সে জন্য নদীর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নদীর জন্য কাজ করতে হবে। নদীকে ভালোবাসাও দেশকেই ভালোবাসা, মাকে ভালোবাসা।

শিক্ষক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়