এইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনবদ্য সমকালের চিত্রায়ণ চিরকালের স্রোতে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ‘সুজন সখী’ অমর প্রণয় কাহিনি, ফারুক আর কবরীকেও অমর করে মহাকালের বুকে রেখে যায়।
কাহিনিতে যেন বাংলা ভাষা সংস্কৃতির আবহমান কালের গ্রামীণ সহজ-সরল জীবনের প্রণয়–আলেখ্য বুনেছেন পরিচালক। প্রেম-বিরহ-অপ্রাপ্তি-প্রাপ্তির দোলাচলে প্রমোদতরীতে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই গুণী পরিচালকের আসল নাম খান আতা বা খান আতাউর রহমান। ছবির কাহিনি আর সংলাপ লিখেছেন কিংবদন্তি আমজাদ হোসেন। সুজন এবং সখী নামের দুই গ্রাম্য সহজ-সরল কপোত-কপোতীর প্রণয়ের কথা বলে ‘সুজন সখী’।
খান আতাউর রহমান, আমজাদ হোসেন, জহির রায়হান—এই ত্রয়ীকে নিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের একটা বৃত্ত রচিত হয়েছিল। এই ত্রয়ীর সঙ্গে সংগীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদকে জুড়ে নিলে বৃত্তটা অনেক প্রসারিত হয়। চলচ্চিত্র জগতের নিপুণ নির্মল আনন্দধারা স্রোতে এবং মননশীল দার্শনিক বিষয়বস্তুর বিস্তারে নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকারে দেখেছি পর পর এসে পড়েছেন চাষী নজরুল ইসলাম, আলমগীর কবীর, তারেক মাসুদ, তানভীর মোকাম্মেলের মতো আরও অনেক পরিচালক।
‘সুজন সখী’ চলচ্চিত্রে সুজন আর সখী একে অন্যের চাচাতো ভাইবোন। যদিও যখন তাদের মধ্যে আলাপ হয়, এই পরিচয় জানা ছিল না। সুজন চরিত্রে আমাদের গ্রাম্য চিরকালীন কানু বা কানাই সেজেছেন ফারুক আর সখী চরিত্রে রাইকিশোরী বা রাধা হয়েছেন মিষ্টি মেয়ে কবরী। সুজনের বাবা লোকমান আর মা মিলে ভাই সুলেমান আর বৃদ্ধা মাকে কথায় কথায় অপমান লাঞ্ছনা করত। ভাইপো সুজন ছিল চাচা সুলেমান এবং দাদীর নয়নের মণি। কিন্তু মিঞা ভাই লোকমান এবং ভাবির জন্য সুলেমান মন চাইলেও ভাইপোকে সারাক্ষণ বাহুডোরে বেঁধে রাখতে পারত না। দাদিও চোখে চোখে হারাত। দুই ভাইয়ের বিবাদ এতটাই তিক্ত হয়ে উঠল যে নিজের ভাগের বিষয়–সম্পত্তি ভাইপো সুজনকে ছেড়ে দিয়ে সুলেমান গ্রাম ছেড়ে দূরে চলে গেল। বৃদ্ধা মা ও সুজনকে হারানোর কষ্ট বুকে নিয়ে চোখের জলে সুলেমানের সঙ্গ নিল। দাদির চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছেন রওশন জামিল। লোকমান হয়েছেন ইনাম আহমেদ, লোকমানের স্ত্রী অন্য এক কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুমিতা দেবী। আর সুলেমান চরিত্রে খান আতাউর নিজে।
সুলেমানের স্ত্রী লক্ষীমন্ত কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে পরপারের ডাকে চলে যায়। সেই কন্যাটির নাম সখী। সখী দাদির আদর–যত্নে বড় হতে থাকে। ভাইপো সুজন দূরে সরে যাওয়া, পরিবার ভেঙে যাওয়া— তদুপরি স্ত্রী বিয়োগব্যথায় সুলেমান নিজের দোকান ব্যবসা সামলানোর পাশে মাঝেমধ্যেই ছাইপাশ গিলে এসে ঘরে ঢোকে। মাতাল হয়ে কন্যাসন্তানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মা তাকে গঞ্জনা করে। সখীর আদর–যত্ন, পিতৃ এবং দাদির স্নেহ যত্নে বেড়ে ওঠায় অবশ্য কোনো ত্রুটি ছিল না।
সময়ক্রমে নাটকীয় ঘটনার মাধ্যমে ভিন গাঁয়ের সুজনের সঙ্গে সখীর আলাপ হয়। আলাপ ক্রমশ মনে–প্রাণে হারানোর প্রণয় বিরহের রূপ নেয়। নব প্রেমিককে নাতনির সঙ্গে দেখতে যায় দাদি, তখন সুজনের মুখে পিতৃপরিচয় শুনে রক্তের সম্পর্কের স্রোত আবার মিলে যায়। সেই একরত্তি বয়সে দাদির কোলে কোলে ঘুরেছে সুজন, বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সব ভুলে গিয়েছিল। আবার মা–বাবা তাকে চাচা সুলেমান সম্পর্কে চিরকাল ভুল বুঝিয়ে এসেছে। ফলে সুলেমানকেও সে ভালো চোখে দেখত না। এবার ধীরে ধীরে সব সম্পর্কের জট কাটতে শুরু করে। আবার সুজন-সখীকে নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে নতুন করে জট তৈরি হয়। সুজনের অন্যত্র বিয়ে ঠিক করে মা–বাবা। সেই পাত্রীর বাবার বিষয়সম্পত্তি অনেক। কিছুতেই সখীকে তারা ঘরে তুলবে না। আবার নাটকীয় দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্যে দিয়ে নিজেদের মধ্যে যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি দূরে ঠেলে দুই প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরকে কাছে পেতে নাছোড়বান্দা।
শেষ দৃশ্য চমৎকার, একালের মুম্বাইয়া লাভ স্টোরিকেও হার মানায়। তবে একেবারে গ্রামবাংলার প্রাণের রসধারায় সিক্ত। এই হলো আমাদের বাংলাদেশের সাহসী পরিচালক খান আতাউর রহমান। এই হলো আমজাদ হোসেনের দুরন্ত দুর্ধর্ষ প্রেমের গল্প।
ছবির কাহিনি, চলচ্চিত্রায়ণ, দৃশ্যায়নের মতো গানগুলোও যে কোনোকালে ভোলার নয়। খান আতার লেখা ‘আরে কথায় বলে /গাছে বেল পাকিলে তাতে কাকের কী /ও কাকের কা কা যদি একে একে /গাছের বেল ঝরিয়া যায় তাতে দোষের কী?’ কী সুন্দর ছন্দ মধুর, সুর শ্রুতিমধুর একটা গান আছে। ‘গুন গুন গুন গান গাহিয়া নীল ভ্রমরা যায়...’ আজও মানুষ গুনগুন করে। ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা /তোমার বেলায় নেব সখী তোমার কানের সোনা /সখী গো, আমি প্রেমের ঘাটের মাঝি /তোমার কাছে পয়সা নিব না’ গানটা দুই বাংলায় এতটাই জনপ্রিয় যে খান আতার পরেও বহু পরিচালক চলচ্চিত্রায়িত করেছেন। কিন্তু খান আতার সাদাকালো ছবির ফারুক-কবরী রূপালী বুনন, গানের প্রণয় নিবেদন কোনোকালেই ভোলার নয়। ছবির মনোমুগ্ধকর গানগুলো লিখেছেন মমতাজ আলী খান এবং গ্রামবাংলার প্রচলিত কোনো নাম না জানা গীতিকার। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন, নীলুফার ইয়াসমিন, আব্দুল আলীম, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, রথীন্দ্রনাথ রায়, গোলাম আম্বিয়া, ইয়ামিন চৌধুরী, মুস্তাফিজুর রহমানের মতো কিংবদন্তি শিল্পীরা। বগা নামের একটি চরিত্রে টেলি সামাদ আগাগোড়া মাতিয়ে রেখেছেন।
ছবিতে গ্রামবাংলার ঝাড়ফুঁক করা ফকির আছে, মনে ধরা নারীর চুল ফকিরের কাছে নিয়ে গিয়ে বশীকরণ করার দৃশ্য আছে। সাপে কাটা রোগীর পায়ের বিষ নিজের দাঁত মুখ দিয়ে তুলে আনার গ্রামীণ অন্ধবিশ্বাস আছে। কিন্তু প্রেমিক যে ভালোবেসে প্রেমিকাকে এ ভাবে বিষমুক্ত করতে পারে, এই রূপক আবেদন ফুরানোর নয়। গ্রামের বাড়ির দাওয়াই বসে বৃদ্ধ নারীর লাউ ধোয়ার দৃশ্য আছে। কাপড়ে সেলাই করে নারীর নকশা ফুটিয়ে তোলার দৃশ্য আছে। কানাইয়ের মতো গাছের ডালে লুকিয়ে রাধার স্নানরত দৃশ্য দেখার দুষ্টুমি আছে। রাতের যাত্রাপালার আসরে চিরকালীন সাড়াজাগানিয়া আসর মাতানো গান আছে। আর এইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনবদ্য সমকালের চিত্রায়ণ চিরকালের স্রোতে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ‘সুজন সখী’ অমর প্রণয় কাহিনি, ফারুক আর কবরীকেও অমর করে মহাকালের বুকে রেখে যায়।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত