সকালে ঘুম থেকে উঠেই বুঝলাম, আজ আর রক্ষা নেই। যা অঘটন ঘটবার ঘটে গেছে। স্কুলের সময় পার হয়ে গেছে, এখন আর যাওয়া সম্ভব নয়। সুখ আর কষ্টের একটি মিশ্র অনুভূতি সৃষ্টি হলো। স্কুলে যেতে আমি আগ্রহী নই, তাই আনন্দিতই হই। তবে পরদিন এ সম্পর্কে কৈফিয়ত দিতে হবে ভাবলেই মনটা দমে যায়।
স্কুলে না যেতে হওয়ায় এখন আমার হাতে যথেষ্ট সময়। গতকালের পত্রিকাটি পড়া হয়নি। দরজার বাইরে পড়ে আছে। ভাবলাম, এবেলা পড়ে নিই। পত্রিকা নিতে দরজা খুলতেই দেখলাম, একটা ছোট সবুজ খাম পড়ে আছে সামনে। ওপরে বেশ সুন্দর করে লেখা—‘প্রিয়ন্তী’।
আমার নাম! বিষয়টি বুঝতে কিছুটা সময় লাগল। একমুহূর্তের মধ্যে চিন্তা করে নিলাম, এ নামের আর কেউ থাকে কি না বিল্ডিংয়ে। সে রকম কারও কথা মাথায় এল না। অবশ্য বেশি ভাববারও সময় পেলাম না। পেছনে মার পায়ের শব্দ শুনে দ্রুত পকেটে চালান করে দিলাম খামটা। তারপর পত্রিকা নিয়ে সোজা নিজের ঘরে। পত্রিকার ভাঁজে খামটি রেখে ভেতর থেকে বের করে আনলাম একটি ছোট কাগজ। এতে লেখা—‘গতকাল তোমার বলা কবিতায় আবেগটা বড্ড কম ছিল’।
গতকাল স্কুলের অনুষ্ঠানে আমি একটা কবিতা আবৃত্তি করেছি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি এই দুটি লাইনের দিকে। এতক্ষণ আমার মধ্যে যে ভয় কাজ করছিল, তা হঠাৎ উবে গেল। আমি হাসিতে ফেটে পড়লাম। হয়তো রাগ করা উচিত ছিল! কিন্তু কেন যেন রাগ করতে পারলাম না।
দ্রুত একটা সাদা কাগজে লিখলাম, ‘ধন্যবাদ। তোমার পরিচয়?’ কাগজটা খামে ভরে বাসার সামনের ঝুড়িতে রেখে দিলাম। এরপর অনেকটা দিন কেটে গেছে। খামটা পড়ে থেকে থেকে কিছুটা বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। তুলে নিয়ে ফেলে দেব ভাবছি, এমন সময় একদিন দেখি, খামটি নেই। সেখানে নতুন একটি খাম। এবারও গাঢ় সবুজ রঙের খামে ভরা ঘিয়ে রঙের কাগজ। এতে লেখা একটি লাইন—‘গতকাল তোমার আবৃত্তি করা কবিতাটি আমার প্রিয়।’
গতকালও আমার রেডিওতে আবৃত্তি ছিল। আমি পুরো কাগজ ও খাম খুঁজে দেখলাম, কোথাও কোনো পরিচয় লেখা নেই। মন খারাপ হলো খুব।
আমার বয়স এখন ৫১। এ বয়সেও আবৃত্তি ছাড়িনি। সেই এক লাইন চিঠির আশায় আজও আবৃত্তি করে যাই। তবে এখন আর পরিচয় খোঁজার চেষ্টা করি না। কারণ, পরিচয়হীন ব্যক্তিটা আজ আমার পরিচিত। পরিচয় পেলেই হয়তো বেড়ে যাবে দূরত্ব, হয়ে যাবে অপরিচিত!