দুর্গ

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

একটি গ্রামে মিলেমিশে বাস করত কয়েকটি পরিবার। সবুজ–শ্যামল সেই গ্রামের একটি হিন্দু পরিবারে ছিলেন হরেন নামের এক যুবক। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীতে সাঁতার কেটে বেড়ে ওঠা তাঁর। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই দিন কেটে যাচ্ছিল। কৃষিকাজ করার পাশাপাশি হরেন নদীতে নৌকা চালান। নায়ে পাল তুলে গলা ছেড়ে গান ভাটিয়ালি। সবাই তাঁকে হরেনদা বলে ডাকত। কারও আপদবিপদ হলে হরেন এগিয়ে আসতেন সবার আগে।

সালটা ১৯৭১। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। চারদিকে হাহাকার। তাঁদের বাড়ির সবাই ভারতে পাড়ি জমালেও হরেন দেশের টানে থেকে যান। স্ত্রী রেনুবালা তাঁকে বারবার মিনতি করেও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। হরেনের একটাই কথা, ‘যে দেশের তরুলতা আমাকে ছায়া দিয়েছে। যে নদীর জল আমার তৃষ্ণা মিটিয়েছে, আজ সেই দেশের দুর্দিনে আমি পালিয়ে যেতে পারব না। এ তুচ্ছ প্রাণ যায় চলে যাক। আমি আমার দায়িত্ব পালন করব।’

প্রতি রাতে হরেন তাঁর নৌকাভর্তি যাত্রী নিয়ে নৌকা ছাড়েন। বাড়ি ফিরে আসেন ফজরের আগে। কেউ জানতেও পারে না হরেন প্রতি রাতে কোথায় যান। কেবল মুক্তিযোদ্ধারা জানেন, গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য হরেনের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নেই। একসময় বাধ্য হয়ে হরেন তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা শিখাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেন ভারতে। সঙ্গে দিয়ে দেন একটি চিরকুট। সেটিতে তাঁর এক আত্মীয়ের ঠিকানা। কিছুদিন পর ভারত থেকে একটি চিঠি আসে। ‘বাবা, আমরা পৌঁছে গেছি এবং ভালো আছি। তুমি নিজের খেয়াল রেখো।’ চিঠি পড়ে হরেনের চোখে জল চকচক করে ওঠে! পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘আমার মা ভালো নেই। তার খেয়াল রাখার জন্যই আমি ব্যস্ত আছি রে মা।’

মুক্তিযোদ্ধাদের নদী পার করা অব্যাহত রাখা হরেনের ওপর আরও একটি দায়িত্ব এল একদিন। কিছু অস্ত্র নায়ে করে আনতে হবে। তারপর সেগুলো নিজের ঘরে রাখতে হবে। কথাটি শোনামাত্র হরেনের মনে পড়ে গেল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ—

‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’

রাজি হয়ে গেলেন হরেন। একদিন অস্ত্র এল। সারা রাত ধরে একা একা লুঙ্গি পেঁচিয়ে সেই অস্ত্র নিজের ঘরে এনে রাখেন তিনি। কিছু পৌঁছে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। আরও কিছু বাকি আছে। এর কয়েক দিন পর এমনই এক রাতে রাজাকারের দল পাকিস্তানি সেনা নিয়ে হাজির হরেনের ঘরে। জ্বালিয়ে দিল তাঁর বাড়িঘর। তুলে নিয়ে গেল হরেনকে। শুরু হলো অমানুষিক নির্যাতন। তবু মুখ খুললেন না তিনি। হাত-পায়ের নখ তুলে নেওয়া হলো। অত্যাচার সইতে না পেরে একটা সময় হরেন নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তাঁর মৃতদেহ নদীতে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হলো।

মনে একটা দুঃখ নিয়ে শহীদ হলেন হরেন। তিনি স্বাধীনতা দেখে যতে পারেননি। যে নদীকে ভালোবেসে জীবন পার করলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে যেতে সাহায্য করলেন জলপথে, সেই নদীই হলো তাঁর শেষ ঠিকানা। আজও বয়ে চলে নদী। জলে সাঁতার কাটে মাছ। নীল আকাশে ডানা মেলে ওড়ে পাখির দল।

পূর্ব বাসাবো, কদমতলা, ঢাকা