ভাঙনের বেদনার চিত্রপটে তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পারে’

‘চিত্রা নদীর পারে’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যছবি: সংগৃহীত

দেশভাগ বা মানুষ ভাগের বেদনা বিজড়িত তানভীর মোকাম্মেলের চলচ্চিত্র ‘চিত্রা নদীর পারে’। দেশ বিভাজনের ওপর গবেষণাধর্মী তানভীরের চলচ্চিত্র একেকটা সময় দেশ–কালের ইতিহাসকে উন্মোচিত করে। কিন্তু সাহিত্যের রসধর্মী কৃষ্টির এই ইতিহাস, গড়পড়তা বাঙালির পড়াশোনায় উঠে আসা রুক্ষ, শুষ্ক, কাটখোট্টা ইতিহাস নয়; মাটির গন্ধে মায়াময়, রক্তমাংসের মানুষের ছায়ায় কায়াময়, আলো–বাতাসে ভরপুর যেন একটা চারা। আবার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয় কালের সাক্ষী গ্রামবাংলার একেকটা নদীর নাম। বুক চিরে বেদনা যেমন উঠে আসে, ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হই, স্মৃতি আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে বহমান গতিধারায় আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

‘চিত্রা নদীর পারে’র ঘটনা সংবহন ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর। পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ভারতে চলে আসা অস্তিত্বের সংকট, দ্বিখণ্ডিত জীবনের আত্মপরিচয় এবং জননী জন্মভূমিকে ছেড়ে না যেতে চাওয়ার আকুল বেদনা, হাহাকার, আর্তনাদ তথ্য বিশ্লেষণের আকারে প্রতিভাষিত হয়েছে। দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষের ভাঙা বাড়ির অযত্ন–অবহেলায় ধসে পড়া দেয়ালে চলচ্চিত্রের নাম এবং অভিনেতা-অভিনেত্রী কলাকুশলীদের নাম দেখিয়ে ঘটনাপ্রবাহের যাত্রা শুরু হয়।

১৩২৭ বঙ্গাব্ধে স্থাপিত ‘পান্থনীড়’ নামের বাড়িটার পরিচয় একটি পরিবারের ইতিহাসের ভাঙা–গড়ার খেলার আলোর ফলক হয়ে দাঁড়ায়। এই বাড়িতে থাকেন বিপত্নীক উকিল শশীভূষণ সেনগুপ্ত, তার বিধবা দিদি অনুপ্রভা এবং শশীভূষণের মা–মরা দুই ছেলে-মেয়ে মিনতি আর বিদ্যুৎ। তানভীরের চলচ্চিত্রজুড়ে স্মৃতির শৈশব খেলা করে। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের সুখানুভূতি দেয়। মিনু আর বলু বাড়ির মধ্যে সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে। গ্রামের ছোটদের মধ্যেও হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদের পৃথিবী ছিল না। সালমা, বাদলদের মতো মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিনু আর বলুদের পিঠেপিঠি বড় হওয়া। নদীর পারে খেলতে খেলতে সবাই গোধূলি পেরিয়ে যায়, আকাশে বকের ঝাঁক উড়ে গেলে বলতে থাকে, ‘বগা, আমায় ফুল দিয়ে যা...বগা আমায় ফুল দিয়ে যা...’।

শৈশবে কারও মনে হয় এই দোয়েল, কোয়েল, বক, গাঙচিলের এথায়–ওথায় উড়ে যাওয়ার স্বাধীন পৃথিবীটা বড় সুন্দর। কেউ আবার ধরিয়ে দেয় বড়দের মুখে শোনা কথা, ‘যার ঘর নেই পৃথিবীতে, তার কিছু নেই।’ এভাবে আপন ঘরের ছায়াই যেন মাথার ওপর আকাশ হয়ে ওঠে। ছোটদের খেলনাবাটির আসরে কেউ বলে ওঠে, ‘নগেন বাবুর মতো তোরাও তো দেশ ছেড়ে চলে যাবি। তোরাও তো হিন্দু।’ মায়াবী শিশু উত্তর দেয়, ‘বাবা বলেছে আমরা কক্ষনো কোথাও যাব না।’ শৈশবজুড়ে ছোটদের ঘুড়ি ওড়ানো, কুমোরের বড় দুর্গাপ্রতিমা গড়ার দেখাদেখি খেলার দুর্গাপ্রতিমা গড়া, বল নিয়ে খেলতে যাওয়া, ঘরে বসে লুডুতে ছক্কা–পুট, এক্কা–দোক্কা, দড়িলাফ—কত ধরনের খেলাই যে উঠে আসে। দড়িলাফ গুনতে গুনতে মিনতি নামের মেয়েটা বড় হয়ে ওঠে। তখনো নদীতে ভেসে ভেসে সাঁতরে স্নান করে বেড়ায়। আর বলু মানে বিদ্যুতের শৈশবে অন্য রকমের অভিজ্ঞতাও থাকে। বাবার নাম জানার পর কবরখানায় মুসলিম লোকটা তাকে বলে ওঠে, ‘মালাউন।’ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের অসম্মান করে একশ্রেণির মুসলিমরা অনন্তকাল ধরে এই শব্দটা ব্যবহার করে আসছে। এমনকি সংখ্যালঘু মানুষের পাশে দাঁড়ানো বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীলদের আজও এই মালাউন গালাগালিটা শুনতে হয়। বলুর শৈশবে এ ধরনের হেনস্তার এতটা প্রভাব পড়ে, বাড়ি এসে সে বলে, ‘আমি আর নড়াইলে থাকব না। কলকাতায় চলে যাব।’

চারদিকেই তো হিন্দুদের এই যাওয়ার পালা। এই আসা-যাওয়ার মধ্যেই দৃশ্যে ওঠে আসে গ্রামের এক পাগল। ঘটনার খুঁটি ধরে সশরীর আমাদের নাড়িয়ে দিতে যেন এই পাগলের আবির্ভাব। তানভীর মোকাম্মেলের পরবর্তী সময়ের ‘জীবনঢুলী’ ছবিতেও তিনি পাগলের চরিত্রে অভিনয় করে আমাদের শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দেন। অন্য কেউ নন, এই পাগল হলেন তানভীরের চলচ্চিত্রের শিল্পনির্দেশক উত্তম গুহ। তানভীরের প্রতিটি চলচ্চিত্রে শিল্পনির্দেশনায় যেমন উত্তম থাকেন, একেবারে যথোপযুক্ত পোশাক পরিকল্পনার দায়িত্বে থাকেন চিত্রলেখা গুহ। এই চলচ্চিত্রে সুন্দর গানও করেছেন তিনি। আর অনবদ্য সুরারোপের দায়িত্বে সৈয়দ শাবাব আলী আরজু। অসামান্য সম্পাদনা করেন মহাদেব শী। একজন মননশীল পরিচালকের সঙ্গে দীর্ঘযাত্রায় এ ধরনের সৃষ্টিশীল মানুষের জুড়ে থাকা নান্দনিক চলচ্চিত্রের উৎকর্ষ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ।

শশী উকিল কিছুতেই দেশ ছেড়ে যাবেন না। তিনি বলেন, ‘আমার দেশের মাটি দবদবাইয়া হাঁটি।’ শামসুদ্দিন উকিলের সঙ্গে শশীভূষণের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। তাকে বলে, ‘দেখো শামসুদ্দিন, তোমাকে তো বহুবার বলেছি আমি যাচ্ছি না কোথাও…।’ অথচ চারদিকে কত রকমের চাপ, কত রকমের চক্রান্ত। নতুন কনটাক্টরি ধরা হামিদ মিয়া শশীকান্তকে বলেছে, ‘দাদা, যদি যান বাড়িটা আমারে বেচবেন।’ এই হামিদ মিয়া শশীর প্রতিবেশী। সকাল-বিকেল যার সঙ্গে দেখা হয়, দুবাড়ির ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে খেলাধুলা করে, সে–ও কিনা এ রকম কথা বলতে পারে!

রামেন্দু মজুমদারকে চলচ্চিত্রে পাওয়া গেল জেল থেকে ছাড়া পাওয়া একজন কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে। শশী উকিলকে তিনি জানাচ্ছেন, কেষ্টপুরের নমশূদ্ররাও দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। না গিয়েই বা করবে কী! যে কমিউনিস্ট নেতা–কর্মীরা তাদের দেশে থাকতে বলত, সেই নেতারাও অনেকেই দেশ ছেড়ে গেছে। তিনি শশীকে বোঝান, বিষয়টা হিন্দু–মুসলিমের নয়; একটা শ্রেণি জাগবে, একটা শ্রেণির পতন হবে—এই হলো অনিবার্য।

‘চিত্রা নদীর পারে’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

১৯৪৭ সালেও পণপ্রথা সামাজিক অভিশাপে পরিণত হয়। পাত্রপক্ষের দশ হাজারের নিচে পণ না চাওয়া, তার ওপরে আবার গয়নাগাটি চাওয়া চলচ্চিত্র থেকে জানা যায়। বিজয় নরসুন্দর শশীভূষণের বাড়ির উঠোনে চুল–দাড়ি কেটে দিতে দিতে বলে, ‘আমাদের এখানে যা কাজ, ওখানেও তাই কাজ হবে।’ নিম্নবর্গের পেশাদারি মানুষের কাজের পরিবর্তন হবে না দেশ ছেড়ে গেলেও, বোঝা যায়।

আবার সময়টাকে সত্যি করে ধরার জন্য অন্য কিছু গবেষণামূলক সাময়িক তথ্যও উঠে আসে চলচ্চিত্রে। ঢাকার রাস্তায় চিত্রবাণী সিনেমায় সপরিবার দেখার মতো ছবি ‘হারানো সুর’–এর মাইক প্রচার হয়। সময়টা বোঝা যায় ১৯৫৭ সালের। কেননা তখন এই ছবি মুক্তি পেয়েছে।

আবার সুচিত্রা সেনের যে কত অনুরাগী বাঙালিদের পূর্ব পাকিস্তানে, সেলুনের নাম থাকে ‘সুচিত্রা সেলুন’। পড়শি ছোট্ট কামালের জন্মদিনে কলেজপড়ুয়া মিনতি গান ধরে, ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে..’। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুর করা লতা মঙ্গেশকরের এই বিখ্যাত গানটিও ১৯৫৬ সালের। বাদল মুগ্ধচিত্তে মিনতির এই গান শোনে। মিনতি কলকাতা যাবে শুনে বাদল যাযাবরের লেখা ‘দৃষ্টিপাত’ বইটা আনতে বলে। ঢাকায় বইটা পাওয়া যায় না।

মুসলিম বাদলের সঙ্গে মিনতির প্রণয়ের সম্পর্ক বহুদিনের। এই সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে যে যা–ই বলুক, দুজনে দেশের মাটিতে ঘর বাঁধতে প্রস্তুত। বাদল ঢাকায় পড়াশোনা করতে যাচ্ছে। বাদলের মুসলিম মায়ের মনে হয়, যাত্রার সময় পেছন থেকে ডাকলে অমঙ্গল হয়। মুসলিম বাবা কিন্তু বলে, এসব হিন্দুয়ানি ব্যাপার। মুসলমানদের বিসমিল্লা বলে রওনা দিলেই হলো। মিনতি বাদলের কাছে চিঠি লেখে। আকুতি থাকে, প্রতি সপ্তাহে বাদলের চিঠি চায়। বাদল বলে, ‘লিখব।’ মিনতি বলে, ‘সত্যি?’ বাদল বলে, ‘বিদ্যা!’ এই যে আচারে সংস্কৃতিতে মেলবন্ধন, ধর্ম এখানে কোথাও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। যদিও ঢাকার রাজপথে স্বদেশী আইন অমান্য আন্দোলনে প্রতিবাদী বাদল একদিন গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে। মুসলমাদের দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখানো মুসলমান পাকিস্তান সরকার মুসলমান-হিন্দু প্রতিবাদী সবাইকে ধরে ধরে হত্যা করছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সহ্য করতে পারছে না।

একটা রেডিও ঘিরে গ্রামের সবাই বসে, শশীভূষণের বাড়িতে মহালয়া শোনার দৃশ্য দেখা যায়। নড়াইলে বসে আকাশবাণী কলকাতা প্রচারতরঙ্গে মহালয়া শোনার সময় আবার কিছুটা ঘড় ঘড় শব্দ ভেসে আসে। শশীকান্তর নির্দেশে মুহুরি নিমাই বাবু নব ঘুরিয়ে অ্যান্টেনা হেলে শব্দ ঠিক করে আনে। চোখের সামনে একেবারে যেন বাস্তব দৃশ্য ওঠে আসে। আবার তানভীর মোকাম্মেলের চলচ্চিত্রে দুর্গাপূজা বরাবরই অন্য একটা বাস্তব মাত্রা লাভ করে। এখানেও দেশের মাটি দিয়ে গড়া একচালা প্রতিমা পূজা দেখা গেল। সেই পূজাজুড়ে গ্রামবাংলার চিরন্তন মৈত্রীর আবহ, মাটি আর মানুষের হৃদয়ের সুর বিনিময়। রেডিও পাকিস্তান থেকে খবর পড়ে ইনজামুল হক। কাশ্মীরে মসজিদে হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। ঢাকা ও খুলনাতেও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে। শামসুদ্দিন পরিবারসহ শশীকান্তকে নিজের বাড়িতে চলে আসতে বলে। পূজার সময় গ্রামে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লাগে। মিনু শামসুদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে থাকে। গ্রামের একদল মুসলিম ছেলে হিন্দুপাড়া পাহারা দেয়।

দুর্গাপূজা দিয়ে ফেরার পথে শশীভূষণের বিধবা ভাইজি বাসন্তীকে একদল পশু মুসলমান ধর্ষণ করে। অপমানে আত্মসম্মানহীনতায় ভুগতে ভুগতে বিজয়াতে প্রতিমা বিসর্জনের সময় সে নদীতে গিয়ে আত্মবিসর্জন দেয়। তানভীরের ছবিতে এভাবে বিজয়াও বারবার পীড়নের আত্মগ্লানিতে ভোগা সত্যিকারের রক্তমাংসের মানবীর বিসর্জন হয়ে ওঠে।

মিনতি বাড়ি থেকে মা–বাবার ছবি খুলে নেয়। অনুপ্রভা শেষবারের মতো তুলসীতলায় প্রদীপ রাখে, ধুনুচি ঘুরিয়ে প্রণাম করে। বাপ–ঠাকুদ্দার ভিটেবাড়িতে তালা লাগিয়ে দেশ ছেড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রায় পাড়ি দেয়। নড়াইল-যশোর-বেনাপোল বাস ছাড়ে। ছোটবেলার ছড়া কাটার মধ্য দিয়ে মিনুর দেশ ভেসে যায়। বাবার চিতাকে সে শুধু তুলে নিয়ে যেতে পারে না। তানভীর মোকাম্মেলের চলচ্চিত্র হৃদয়ে স্মৃতি জাগায়। চোখে জল এনে দেয়।
মিনতি চরিত্রে আফসানা মিমি সত্যিকারের বাংলাদেশের একটি রাঙাবরন শাপলা। বর্ণমালার মতো সুন্দর। রওশন জামিলের মতো বৃদ্ধ মাসি–পিসিরা আজও গোটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে। তাঁদের আঁচলে চাবির গোছা প্রজন্মকে ধরে রাখার সম্পদ। সুমিতা দেবী, তৌকীর আহমেদ, অগণিত ছোট–বড় অভিনেতা সবাই অনন্য। তানভীরের চলচ্চিত্রে অসংখ্য সাধারণ মানুষের অভিনয়ের সুযোগ থাকে। বাস্তবের চরিত্রকে বাস্তবের পর্দায় নিয়ে আসতে পারেন তিনি। সুন্দর বাংলাদেশের মা–মাটি–মানুষের গন্ধে ফুটিয়ে তোলেন সৌন্দর্যের চিত্রপট। বেদনার মানবিক গাথা।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত