নেইমার যেন ফুটবলের দুঃখী রাজপুত্র

ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে শট নেওয়ারই সুযোগ পাননি নেইমারছবি: রয়টার্স

সময়টা ২০১০ সাল। কয়েক দিন পরই দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবে বিশ্বকাপ ফুটবল। দল ঘোষণা করলেন তৎকালীন ব্রাজিল কোচ কার্লোস দুঙ্গা। কিন্তু সেই দল নিয়ে চারদিকে ব্যাপক সমালোচনা। দলে যে রাখা হয়নি বিস্ময়বালক নেইমার জুনিয়রকে!
তখন পর্যন্ত ব্রাজিলের জার্সিতে অভিষেক হয়নি নেইমারের। কিন্তু ক্লাব ফুটবলে সান্তোসের হয়ে একের পর এক রেকর্ড গড়ে যাচ্ছেন, পায়ের জাদুতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার পাশাপাশি মুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন চারদিকে। ড্রিবলিং ও গোল করার দক্ষতায় অনেকে তাঁকে ‘নতুন পেলে’ বলেও আখ্যায়িত করেন। ব্রাজিলের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং বিলবোর্ড—সব জায়গায় কেবল তাঁর খবর। অথচ সবে তখন ১৮ বছরে পা দিয়েছেন নেইমার! জাতীয় দলে খেলার আগেই ফুটবল–পাগল দেশটির বড় তারকায় পরিণত হন।

পরে বিশ্বকাপ–ব্যর্থতায় ছাঁটাই হন কোচ দুঙ্গা। সেলেকাওদের দায়িত্ব পান মানো মেনেজেস। তাঁর প্রথম কাজই ছিল নেইমারকে দলে নিয়ে আসা এবং সেটা তিনি করলেন। ২০১০ সালের ১০ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে ব্রাজিলের জার্সিতে অভিষেক হয় নেইমারের। ২-০ গোলের ব্যবধানে জেতা ওই ম্যাচে গোল পান তিনি। এর পরের গল্পটা সবার জানা। এরই মধ্যে দলটির হয়ে ১২৪ ম্যাচ খেলেছেন এবং গোল করেছেন ৭৭টি, যা ফুটবলের রাজাখ্যাত কিংবদন্তি পেলের সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ।

গোলের পর নেইমার
ছবি: রয়টার্স

কিন্তু গল্প এখানেই শেষ করলে মনে হবে ফুটবল হয়তো পিএসজি তারকাকে সবই দিয়েছে। সত্যিকারের গল্পটা যে বলছে ভিন্ন কথা! ফুটবল কখনোই নেইমারকে দুই হাত ভরে উপহার দেয়নি। দুই পক্ষের মধ্যে বারবার দুঃখের গল্পই রচিত হয়েছে।

২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ঘরের মাঠে। ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’–তে প্রথমবার নেইমারের অংশগ্রহণ। নিজের প্রথম বিশ্বকাপ হলেও দলটির সবচেয়ে বড় তারকা তিনিই। ঘরের মাঠে হওয়ায় প্রত্যাশার চাপও অনেক। তবে সেই চাপ বেশ ভালোভাবে সামাল দিয়ে দলকে নিয়ে যান কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি। সেমিফাইনালেও তুলেছেন। কিন্তু খেলতে পারেননি। কলম্বিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের মারাত্মক ট্যাকলের শিকার হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়। সেই আঘাতে দর্শকদের পাশাপাশি ভেঙে পড়েন সতীর্থরাও। তাই তো সেমিতে জার্মানির বিপক্ষে চিরচেনা ব্রাজিলকে দেখা যায়নি। হারতে হয়েছে ৭-১ গোলের বড় ব্যবধানে। লজ্জার সেই ম্যাচটি পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নরা নিশ্চিতভাবেই ভুলে যেতে চাইবেন।

চোটের কারণে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে পুরোপুরি ফিট ছিলেন না নেইমার। তার ওপর প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের ট্যাকলের পর বারবার মাঠে ড্রাইভ দেওয়া নিয়েও সমালোচনার শিকার হন। দলও কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের কাছে হেরে বিদায় নেয়। সব মিলিয়ে ওই টুর্নামেন্টে ভালোবাসা পাওয়ার বদলে উল্টো অসংখ্য সমালোচক পেয়েছেন তিনি।

ম্যাচ শেষে কাঁদছেন হতাশ নেইমার
ছবি: রয়টার্স

তবে কাতার বিশ্বকাপের গল্পটা ভিন্ন হতে পারত। এবার সম্পূর্ণ চোটমুক্ত হয়ে কাতারের মাটিতে পা রাখেন তিনি। পিএসজির হয়ে চলতি মৌসুমটাও বেশ উড়ন্ত কাটছে তাঁর। বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচের আগে অধিনায়ক থিয়াগো সিলভা বলেছিলেন, ‘এবার ভিন্ন নেইমারকে দেখবে বিশ্ব।’ কিন্তু নিয়তি যে লিখে রেখেছে একই গল্প। আবারও চোটের হানা। প্রথম ম্যাচেই সার্বিয়ার বিপক্ষে চোটে পেয়ে উঠে যান। গ্রুপ পর্বের বাকি দুই ম্যাচ খেলতে পারেননি। শঙ্কা জেগেছিল পুরো টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ার। তবে সেই শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামেন। দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে দলকে জেতানোর পাশাপাশি হয়েছেন ম্যাচসেরাও। সুস্থ নেইমার কেন প্রতিপক্ষের জন্য ভয়ংকর, সেটা বেশ ভালোভাবেই টের পেয়েছে এশিয়ান পরাশক্তিরা। কোয়ার্টার ফাইনালের আগে ভক্তদের প্রত্যাশাও বেড়ে যায়।

ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে নেইমার খেলেছেন, বারবার প্রতিপক্ষের রক্ষণে ত্রাস ছড়িয়েছেন, গোলকিপারকে কাটিয়ে দুর্দান্ত গোলও করেন। তখন কে ভেবেছিল, কয়েক মিনিট পরই আরও একটি দুঃখের গল্প রচিত হবে! নিয়তি যে বিশ্বকাপে নেইমারের জন্য আরও একটি কষ্টের অধ্যায় লিখে রেখেছে। খেলা পেনাল্টিতে গড়ালেও শট নেওয়ার সুযোগ পাননি, দল তার আগেই হেরে যায়। এই দুঃখ হয়তো দীর্ঘদিন পোড়াবে ব্রাজিলিয়ান পোস্টার বয়কে।

নেইমার ব্রাজিলের জার্সি আবারও গায়ে জড়াক। এই জার্সিতেই তাঁকে সবচেয়ে বেশি মানায়।
ছবি: রয়টার্স

বয়স মাত্র ৩০। ফর্ম ও ফিটনেস ধরে রাখতে পারলে খেলতে পারবেন আরও অন্তত দুটি বিশ্বকাপ। কিন্তু বিশ্বকাপের সঙ্গে এই দুঃখগাথার কারণেই কিনা কাতারে আসার আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, হয়তো এটাই হতে পারে তাঁর শেষ বিশ্বকাপ এবং এটা মেনে নিয়েই খেলবেন। তাই তো ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে পরাজয়ের পর সাংবাদিকদের কাছ থেকে প্রশ্নটি উড়ে আসে। জবাবে ব্রাজিল সুপারস্টার হ্যাঁ–না কিছুই বলেননি। ব্রাজিলের জার্সি আবারও গায়ে জড়াবেন সেটা যেমন বলেননি, তেমনই অবসর নেবেন কি না, তা–ও নিশ্চিত করেননি। নেইমার বলেছেন, ‘বিষয়টি নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হবে। এই মুহূর্তে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না। আমি সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাই, আমার এবং জাতীয় দলের জন্য কোনটা ভালো হবে। আমি দরজা বন্ধ করিনি। আবার এটাও শতভাগ বলতে পারছি না যে আমি ফিরব (জাতীয় দলে) কি না।’

সমর্থক হিসেবে একটাই চাওয়া, নেইমার ব্রাজিলের জার্সি আবারও গায়ে জড়াক। এই জার্সিতেই তাঁকে সবচেয়ে বেশি মানায়। পরিসংখ্যান বলে বয়স ৩০-এর পর ফুটবলারদের পারফরম্যান্স আরও ধারালো হয়, সেরা সময় আসে। নেইমারের সেরা সময় কেবল শুরু হলো। এখনই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি না টানুক। বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি জয়ের সুযোগও আসবে। বর্তমান ব্রাজিল দলটির অধিকাংশ খেলোয়াড়ের আদর্শ তিনি। অনুপ্রেরণার এই গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে যাক। তাঁকে দেখে আরও বিশ্বমানের ফুটবলার তৈরি হোক।