প্রকৃতির পাঠশালায় একদিন

লেখক ও তাঁর ভ্রমণ সঙ্গীরা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

পাহাড়ে, বনে-জঙ্গলে, ঝিরিতে ট্র্যাকিং ও ক্যাম্পিং করে প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং নির্মলতায় নিজেকে নিমজ্জিত করার যে আনন্দ খুঁজে পাই, তা জীবনের চলার পথে অনুপ্রাণিত করে সব সময়। প্রকৃতির সব জায়গায় সৌন্দর্যে ভরপুর।

পাহাড়, মেঘ ও নীলাকাশের সঙ্গে সন্ধি করতে ঢাকার সায়েদাবাদ বাসস্টেশন থেকে ২০ জুন রাতে দশজন প্রকৃতিপ্রেমীর ছোট্ট এক বহর নিয়ে ছুটে চলা বান্দরবানের উদ্দেশে। নেতৃত্বে ছিলেন দেশের প্রাণ-প্রকৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষার অদম্য এক যোদ্ধা হোসেন সোহেল ভাই।

ভোরের আলো ফুটতেই চোখে পড়ল রাস্তার দুই পাশের বিশালাকৃতির সবুজ পাহাড়। এর মধ্যেই আমাদের বাস এঁকেবেঁকে ছুটে চলছে। প্রায় ৯ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রা শেষে পৌঁছে যাই আলীকদমের দ্য দামতুয়া ইন রিসোর্টে। সবাই দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বন বিভাগ ও বিজিবির আনুষ্ঠানিকতা শেষে পাহাড়ি চান্দের গাড়িতে চেপে বসলাম। এখান থেকেই আমাদের প্রকৃতির পাঠশালার যাত্রা শুরু।

রেংয়পাড়া বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল
ছবি: লেখক

আলীকদম বাজার থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে জিরো পয়েন্টে চলে আসি। জিরো পয়েন্টের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৫০০ ফুটের বেশি হবে। যত দূর চোখ যায়, শুধুই সবুজ পাহাড়, মাইলের পর মাইল অরণ্যের উল্লাস। পাহাড়ের সৌন্দর্য সমতল থেকে ভিন্ন। পাহাড়ের কাছে গেলে তার মৌনতা এবং বিশালত্ব একদিকে পুলকিত করে, অন্যদিকে বিস্ময় জাগায়।

এদিকে আমাদের আসার খবর পেয়ে রেংয়পাড়া স্কুলের মাস্টার দোয়ারঞ্জন চাকমা ও কয়েকজন শিক্ষার্থী চলে আসে দুর্গম পাড়া থেকে। তাদের পিছু পিছু ছুটে চললাম দুর্গম সেই পাড়ার দিকে। পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল প্রকৃতির বিবিধ সজ্জাতে। কী অপরূপ রূপ! এই সময়ে পাহাড়ের ঢালে প্রচুর পরিমাণে জুমচাষ হয়। জুমের সবুজ সমারোহে চারদিকে আচ্ছাদিত হয়ে আছে। এরই মধ্যে পুরো পাহাড় কালো মেঘে ঢেকে গেল। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড় দেখা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, পাহাড় নিজেই মিশে গেছে মেঘের সঙ্গে।

যেতে যেতে মিন্নাই মুরংসহ আরও কয়েকজন পাহাড়ি নানা সুস্বাদু ফলের ভান্ডার নিয়ে হাজির। ছিল পাহাড়ি বুনো কলা, কাঁঠাল, কাঁচা-পাকা আম, লটকন (মুরং ভাষায় উইক ফক ওই)। দেখা মিলল জুমঘরের। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা মূলত জুম সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ জন্য এই জুমঘর তৈরি করে। এ ছাড়া জুমঘরের আরেকটি বিশেষত্ব হলো, পাহাড়িদের বিবাহের পর নবদম্পতিরা বাসরঘর হিসেবে জুমে রাতযাপন করেন। তাই ঘরটি স্থানীয়দের কাছে পবিত্র স্থান বলে বিবেচিত হয়। জুমঘরে আরও চোখে পড়ল তুইয়া (পানি রাখার পাত্র)। ছয়-সাত ঘণ্টা ট্র্যাকিং করার পর পৌঁছাই নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ি ইউননের গহিন জঙ্গলে ঘেরা রেংয়পাড়া উপত্যকায়। এখানে মুরং জাতির বাস। মুরংদের নিজস্ব শিক্ষা, ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। তারা খুবই প্রকৃতিপূজারি। তবে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর থেকে মুরং জাতি এখনো অনেক পিছিয়ে। যদিও একাধিক সংস্থা এখন তাদের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

যাহোক, রাতযাপনের জন্য ঠিক হয় পাড়ার প্রধানের বাসগৃহ; যাকে কার্বারি বলে সম্বোধন করা হয়। সেখানে রাতের খাবার হিসেবে ছিল পাহাড়ি বন মোরগ, বাঁশকোরাল ও বিন্নি চালের ভাত। রাতের খাবার শেষে পাড়ার সবার সঙ্গে মতবিনিময় ও আড্ডা জমে ওঠে বেশ।

পাহাড়ে জুমঘর। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা মূলত জুম সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ জন্য এই জুমঘর তৈরি করে
ছবি: লেখক

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি, পাড়ার সব বাচ্চা ছেলে-মেয়ে আমাদের দিকে সুন্দর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাদের চাহনির মধ্যে যে ভালোবাসা ছিল, তা আমাকে সব সময় আকুল করবে। যদিও আমরা কেউ কারও মুখের ভাষা বুঝি না। কেউ কারও সম্পূর্ণ মনের ভাব প্রকাশ করতে পারিনি সঠিকভাবে।

এরপর চলে যাই রেংয়পাড়া বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে। স্কুলে অর্ধশত শিক্ষার্থী একই সঙ্গে মুরং, বাংলাসহ আরও কয়েকটা ভাষাতে শিক্ষা গ্রহণ করে। উপলব্ধি হয়, এমন কিছু শিক্ষা তাদের থাকা প্রয়োজন, যেটার মাধ্যমে নতুনভাবে জীবন শুরু করার সময় তারা কাজে লাগাতে পারে। পাহাড়ে শিক্ষার আলো ফোটাতে হোসেন সোহেল ভাই নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। সোহেল ভাইয়ের অফুরন্ত চেষ্টাই এই পাহাড়ের ২ হাজার ৫০০ ফুট ওপরে তৈরি হয়েছে স্কুলটি, যা খুবই প্রশংসনীয়।

মুরংরা খুবই অতিথিপরায়ণ। প্রকৃতির পাঠশালাতে আমাদের ভ্রমণের সঙ্গী আরও ছিলেন মানিক ভাই, গৌরাঙ্গ দাদা, শেখ সেলিম ভাই, শ্যামা দিদি, সাকিব ভাই, স্মরণ ভাই, মারুফ ভাই ও ফাহিম ভাই। সবাই মিলে এই অল্প সময়ে দুচোখে যা দেখেছি, যে প্রকৃতি শিক্ষা, বোধ ও স্মৃতি নিয়ে ফিরেছি, তা অনেক দিন মনে থাকবে। ভালো থাকুক পাহাড়-প্রকৃতির মানুষেরা।

অর্থসম্পাদক, ড্যাফোডিল বন্ধুসভা