আকাশছোঁয়া সুখ

রেলস্টেশন, প্রতীকীছবি: কামাল হোসেন

রেলস্টেশনে প্রায় সময়ই আসা হয় অন্তুর। কোথাও যেতে কিংবা কাউকে বিদায় জানাতে নয়, সে আসে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের আসা-যাওয়া দেখতে। একজন সুস্থ সাধারণ মানুষের এমন অদ্ভুত ভালো লাগা দেখে অবাক হতে হয়।

অন্তু এখনো বেকার। সবে চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগ থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত কোনো চাকরি খুঁজবে না বলে মনস্থির করেছে। কারণ একটাই, তার স্বপ্ন, কোনো একটি সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করবে। কিন্তু সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করতে হলে আগে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। অন্তু এটা জানেও। তবু আশা করছে, টিউশন করে যা শিখছে, বাকিটুকু বিসিএসের জন্য টুকটাক পড়াশোনা করলেই হবে। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস থাকলেও সেই জায়গাটুকু যেন খানিক দুর্বল। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও বর্তমানের প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি সম্পর্কে অন্তুর এমন আত্মবিশ্বাস আসলেই দুঃখজনক।

সে রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে প্রায় সময়ই দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেনের হুইসেল বাজানো দেখে। ট্রেন সময়মতো প্ল্যাটফর্মে আসছে এবং পুনরায় নিজ নিজ গন্তব্য ছেড়ে চলে যাচ্ছে কি না, তা-ও দেখতে থাকে। ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা আছে। মাঝেমধ্যে একটু-আধটু এদিক-সেদিক হলেও ট্রেনগুলোর কোনো বিশ্রাম নেই। গতি বিরতিহীন। তবে মানুষের স্বপ্ন দেখায় কোনো বিরতি নেই। অন্তু দেখতে থাকে, কীভাবে ট্রেনের যাত্রীদের জন্য দুই-চারজন কুলি তাদের পেশাদারত্বের কথা মনে রাখে। একজন পানি বিক্রেতা যুবক কীভাবে ‘এই পানি, এই পানি লন পানি’ কিংবা ‘আমড়া খাইলে আমড়া’ বলতে থাকা একজন আমড়াওয়ালা যুবকের আমড়া বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করার দৃশ্য অন্তুর কাছে হাস্যকর মনে হয়। সে মনে করে, যে দেশে চাকরি বলতে মেধার কোনো মূল্য নেই, সেই দেশে এই অল্প শিক্ষিত যুবকেরা ঠিকই তাদের পেট চালিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে আমার মতো অনার্স পাস করা একজন ছেলে আজও মামা-খালুর সুপারিশ ছাড়া কোনো চাকরি না পেয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে ট্রেনের গতিপথ দেখতে থাকি। তার চেয়ে বরং গ্র্যাজুয়েশনের সার্টিফিকেট মুড়িয়ে আমড়া বিক্রি করে অনায়াসে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে পারা যাবে!

অন্তু আসলেই অনেক হতাশ। সে প্রতিদিনই চিন্তা করতে থাকে স্টেশনে এসে আর দাঁড়িয়ে থাকবে না। ভালো লাগাকে বিসর্জন দিতে চায় ব্যর্থতা নামক স্টেশনের শেষ গন্তব্যে। কিন্তু এমন হতাশাগ্রস্ত সময়ে যদি একটা আশ্চর্যজনক কিছু হয়ে যায়! হলোও তা-ই। অন্তুর ফোনে হঠাৎ একটা সরকারি নম্বর থেকে মেসেজ আসে। মেসেজে লেখা, ‘অভিনন্দন, মো. আবেদ ফারুক অন্তু। আপনি বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সহকারী স্টেশনমাস্টার পদে নিয়োগ পেয়েছেন। আপনার আবেদন নম্বর ক০২৩...।’ এটি দেখে অন্তু বেশ অবাক হলো। কীভাবে সম্ভব! কিছুদিন আগেই তো এই স্টেশনে আর ফিরে না আসার পরিকল্পনা করছিলাম। আর এখন দেখছি স্টেশনে আসার ব্যবস্থা খোদ স্টেশনই করে দিয়েছে। এ যেন শেষ গন্তব্য আকাশছোঁয়ার স্বপ্নকে বাস্তব করে দিল।

বেশ কিছুদিন আগে একটা জাতীয় পত্রিকায় রেলওয়েতে লোকবল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেছিল অন্তু। কিন্তু সে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। আজ এই মেসেজ দেখার পর উপলব্ধি করছে, একটা চাকরি পাওয়া একজন মানুষের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আশাহত না হয়ে নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস বাড়ানো উচিত। একদিন না একদিন সেই আত্মবিশ্বাস স্টেশনের শেষ গন্তব্য নয়, আকাশছোঁয়া সুখের স্টেশনে নিয়ে যাবে অনায়াসে।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা