লীলাবতীই তাহলে খনা?

বটতলার নন্দিত নাটক খনার ৮৮তম প্রদর্শনীর একটি দৃশ্যছবি: রাইন চৌধুরী

যতক্ষণে শিল্পকলার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে ঢুকলাম, ততক্ষণে নাটক শুরু হয়ে গেছে। চারপাশে অন্ধকার। মাঝখানে টিমটিমে আলোয় কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। তাঁদের থেকে ভেসে আসছে নাটকের সংলাপ। টিকিট দেখে দায়িত্বরত একজন বসার রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। চুপচাপ নির্ধারিত চেয়ারে বসে পড়লাম। নাটক চলছে। এক এক করে নাট্যশিল্পীরা আসছেন, যাচ্ছেন। আমাদের মতো আরও অনেকে বসে আছেন। সবার দৃষ্টি মাঝখানের শিল্পীদের ওপর। শুরুতে মিনিট চারেক কাহিনিতে ঢুকতে কষ্ট হলেও পরে খনা আর তাঁর আশপাশের মানুষদের চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি। প্রত্যেকেই যেন নিজেকে ছাপিয়ে গিয়ে তাঁর চরিত্রের মধ্যে ঢুকে গেছেন।

‘খনার বচন’ কথাটি ছোটবেলা শুনে থাকলেও কখনো খনা চরিত্রটি নিয়ে আলাদা করে জানা হয়নি। এদিকে অনেক দিন ধরে থিয়েটার নাটক দেখার ইচ্ছে হচ্ছিল খুব। সময়-সুযোগ না মেলায় সেই তৃষ্ণাও নিবারণ করতে পারছিলাম না। গত শনিবার অফিসে বসে ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি, শিল্পকলায় বটতলার নন্দিত নাটক খনার ৮৮তম প্রদর্শনী হবে। অফিস শেষে বন্ধু রাইনকে অনেকটা জোর করেই নিয়ে চলে গেলাম সামিনা লুৎফা নিত্রার লেখা এবং মোহাম্মদ আলী হায়দারের নির্দেশনায় মঞ্চায়িত নাটক খনা দেখতে। চোখের সামনেই একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকল বরাহ, মিহির, লীলাবতী, রাজা, রানি, সভাসদ, রাখালসহ অন্য চরিত্রগুলো।

আলো-আঁধারের খেলায় কখন যে নাটকের মধ্যে ঢুকে গেলাম, টেরই পাইনি। একটা কথা বারবার কানে বাজছিল, ‘জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, তিন না জানেন বরাহ।’ কিন্তু বরাহ নিজেকে সবজান্তাই মনে করত। এমনকি সেই সূত্র ধরে অপয়া সাব্যস্ত করে নিজ ছেলেকে ত্যাগ করতেও দ্বিধা করেনি। বড় হয়ে সেই মিহির ফিরে এসে তার গণনা চূর্ণ করে দেয়। অন্যদিকে মিহিরের প্রণয়িনী যখন এক এক করে বরাহের ভুল ভাঙতে শুরু করেন, তখনই শুরু হয় বিদ্বেষ। লীলাবতীকে কেন্দ্র করেই মূলত এই নাটক। বরাহ সত্যকে সহজে মেনে নিতে চায় না। লীলাবতী এরই মধ্যে জনসাধারণ থেকে শুরু করে প্রাসাদের মধ্যে নিজেকে বিদুষী জ্যোতিষী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। সে থাকতে চায় সত্যের সঙ্গে। ভুলের কাছে মাথা নত করতে কোনোভাবেই সে রাজি নয়। অন্যদিকে বরাহ তার ঈর্ষা, প্রতিপত্তি হারানোর ক্রোধ—সব যেন লীলাবতীর ঘাড়েই চাপাতে চায়। শেষমেশ সেই কিনা পুত্রকে লীলার জিহ্বা কর্তনের নির্দেশ দেয় এবং না হলে নরক দর্শনের ভয় দেখায়।

বটতলার নন্দিত নাটক খনার ৮৮তম প্রদর্শনীর একটি দৃশ্য
ছবি: রাইন চৌধুরী

নানা সমস্যার সমাধানে লীলাবতীর মুখ থেকে শব্দজাল বের হতো। যার মধ্যেই থাকত সমাধান কিংবা ভবিষ্যদ্বাণী। ‘যদি বর্ষে আগনে, রাজা যায় মাগনে। যদি বর্ষে পুষে; কড়ি হয় তুষে। কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত। আগে খাবে মায়ে, তবে পাবে পোয়ে’—এগুলো সবই আমরা খনার বচন হিসেবেই শুনে আসছি ছোটবেলা থেকে। কিন্তু সেই কথাগুলোই কাল হয়েছিল লীলাবতীর। পিতৃনির্দেশে মিহির নিজ স্ত্রীর জিহ্বা কাটতে পিছপা হয়নি। বাধা দিতে পারেনি নিজ ভালোবাসার বন্ধনও। বরাহের ঈর্ষার কাছে হারতে হয়েছিল লীলাবতীকে। নিজেকে বিসর্জন দিলেও সত্যের কাছে মাথা নত করেননি তিনি। হাসতে হাসতে বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজেকে। নিজের কথা রেখে গিয়েছিলেন সাধারণের কাছে। এমনটাই উঠে এসেছে নাটকের গল্পে। লেখিকা সামিনা লুৎফা নিত্রা বেশ যত্ন করেই লিখেছেন গল্পটা।

সেই লীলাবতীই খনা নামে পরিচিতি পায় মানুষের মধ্যে। যদিও খনার বাস্তবিক জীবন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা আছে। ইতিহাসে এ নিয়ে মতানৈক্য আছে অনেক। তবে খনা বলে একজন মহিলার অস্তিত্ব ছিল, সে বিষয়ে সবাই একমত। নাটকে গল্পের রচয়িতা সামিনা লুৎফা নিত্রা স্বয়ং লীলাবতী তথা ‘খনা’র চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আমাদের সঙ্গে দর্শকসারিতে জনাতিনেক স্কুলপড়ুয়া শিশুও ছিল। বাবা-মা হয়তো নতুন প্রজন্মকে খনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই এনেছিলেন তাদের। নাটক শেষে করতালি দিয়ে শিল্পীদের অভিবাদন জানান সবাই। অন্যদের সঙ্গে বেরিয়ে আসি আমরাও।