ইতি, জয়নুল

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমার মা কেমন যেন নেতিয়ে যায়। মায়ের চোখ অনেক কথা বলে ঠিকই, কিন্তু সে ইশারা ভাষা হয়ে ঠোঁট পর্যন্ত পৌঁছায় না। আমিও কখনো এর কারণ জিজ্ঞাসা করিনি। তবে আমি মায়ের মন খারাপের কারণ জানতাম। জানতাম, ভাষা আন্দোলনের সময় তার খুব কাছের একজন শহীদ হয়েছে।

কারণ জানতে আমার লুকিয়ে মায়ের ডায়েরি পড়তে হয়নি। এর বছর কয়েক পর মা একদিন আনমনে বলা শুরু করল, ‘জানিস আশা, ভাষা আন্দোলনের পরে যখন বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেওয়া হলো; এর পরের একটা বছর আমি নিজের বিবেকের কাছে বোবা ছিলাম। তোর নানুর পুরোনো বাড়িতে তো গিয়েছিলি, চার বিল্ডিং পরে একটা ছেলে রোজ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তাদের পোষা ময়নার সঙ্গে কথা বলত। আমার বয়স তখন ষোলো পেরিয়ে সতেরোতে যাবে যাবে। খোলা হাওয়ার তালে ওড়ার বয়স। রোজ চোখের ব্যায়ামের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ধীরে ধীরে কীভাবে যেন আমাদের ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

আপেক্ষিক দৃষ্টিতে দেখলে তোদের জেনারেশনের ভাষায় সিনিয়র–জুনিয়র বন্ধুত্ব। আমাদের গল্পের বই দেওয়া–নেওয়ার অজুহাতে অনেক দফায় দেখাও হয়ে গিয়েছে। সেবার আমার জন্মদিনের কয়েক দিন আগ থেকে ঢাকা শহরজুড়ে ভাষা আন্দোলনের স্লোগান। এরপর আমার জন্মদিন এল। বড় আশা নিয়ে জন্মদিনের উপহার হিসেবে তার প্রিয় একটি উপন্যাস চেয়েছিলাম। উপন্যাসটা পেয়েছিলাম জন্মদিনের ঠিক দুই দিন পরে। মলাট উল্টে দেখি লেখা—‘তমার জন্য শেষের কবিতা, ইতি জয়নুল’। মলাটের ওপরে জয়নুলের কয়েক ফোঁটা রক্তও বোধহয় ছিল।

আমার আক্ষেপ কি জানিস; জয়নুল কখনো জানল না তার পাশে বসা জড়তায় কথা বলতে গিয়ে তোতলানো মেয়েটার তোতলানোর কারণ সে নিজে ছিল।

মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়ছে। আমি জানি, বাবাও এই গল্প জানে। হয়তো জানে বলেই বাবা মাকে আজও এত ভালোবাসে। আমাদের মুখের বুলি, সহজাত করে বলে দেওয়া ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ গুটিকয়েক বর্ণমালা নিজেদের বলে দাবি করতে আসলে কত ভালোবাসা শহীদ হয়েছে। ভাবলে অবাক লাগে না? মা সারাজীবন একটা না হওয়া সম্পর্কের পরিচর্যা করে গেল। একটা শেষের কবিতা শেষ অবধি আগলে রাখল।

মা আজ পায়েস রান্না করেছে। আমাকে চুলার পাশে বসিয়ে দিয়ে বারবার বলে যাচ্ছে। পায়েস রান্না অনেকটা সম্পর্কের পরিচর্যার মতো। সব সময় যত্ন দিয়ে নেড়ে যেতে হয়। না হলে পুড়ে যায়।