‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু’
ঘরের কাছে প্রকৃতির দুর্নিবার হাতছানি খুঁজে পাওয়া যায় কবিগুরু রবি ঠাকুরের কবিতায়।
সুজলা-সুফলা শস্য–শ্যামলা আমাদের বাংলাদেশ। অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি প্রকৃতি আধার পটিয়া। চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণে সুফিসাধক হজরত শাহাচান্দ আউলিয়া ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্মৃতিবিজড়িত এলাকা। ছবির মতো ছোট শহরটি চানখালী খালের পাড়ে অবস্থিত। চানখালী ধীরগতিতে গিয়ে মিলিত হয়েছে কর্ণফুলী এবং শক্সখনদে নদের সঙ্গে। চানখালী খালের পাড়ে গড়ে উঠেছে লবণশিল্প।
পটিয়া ১৭টি ইউনিয়ন এবং ১টি পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। আয়তন প্রায় ৩১০ দশমিক ২৩ বর্গকিলোমিটার। পটিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বৈলতলী রোড বা আনোয়ারা রোড হয়ে ছনহরা যাওয়া যায়। ছনহরা ইউনিয়নে চাটরা গ্রামে মুরালী ঘাট অবস্থিত। সিএনজি রিজার্ভ নিলে ভাড়া নেবে ১৫০ টাকা। আসা-যাওয়া ৩০০ টাকা। যাওয়ার পথে ভাটিখাইন এবং ছনহরা, ধাউরডেঙ্গা, গুয়াতলী, মটপাড়া চোখে পড়বে। ছবির মতো অপরূপ সুন্দর গ্রামগুলো। সবুজ–শ্যামল পাখিডাকা, ছায়াঘেরা, পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চানখালী ও কেরাঞ্জ খাল। রাস্তার পাশে সবুজ ধানখেত, সারি সারি নানা রকমের বৃক্ষরাজি, ভাটিখাইন স্কুল, অমল চৌধুরী মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট, দিঘি, পুকুর, আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে গেলে দেখা মিলবে মুরালী বাজার।
হেমন্তের এই সময়ে রাস্তার দুপাশে সোনালি ধানের ফসলে ভরে ওঠে মাঠ। পাকা ধানের ম–ম গন্ধ। বিল–ঝিলের ধারে সবুজ চাটাপাতাগাছ। চাটাপাতাগাছগুলো শুকিয়ে চাটা তৈরি করা হয়। কিষান-কিষানিরা ফসল তুলতে ব্যস্ত। সোনালি ধানের নৃত্য অসাধারণ, যেন লজ্জাবতীর পায়ে নূপুরের রিনিঝিনি। ধানি জমিতে পানি আর কাদা জমে থাকে। চোখে পড়বে শুভ্র বর্ণের একঝাঁক কানিবক মাছ শিকারে ব্যস্ত। হিজলগাছে ডাকছে ঘুঘু। এ জন্য বোধ হয় কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে, পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে, পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দুজনার মনে, আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে’। যাওয়ার পথে শ্রীমতি খাল পাড়ে শুভ্র কাশবনের দেখা মিলবে। আকাশে পেঁজাতুলো মেঘবালক-বালিকার ছোটাছুটি।
শুভ্র কাশফুলের হাসি সৌন্দর্যের বহু বর্ণ ভ্রমণপিয়াসীদের বিমুগ্ধ করে। গুন গুন করে যে কারও গাইতে ইচ্ছা করবে, ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমেলা, নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা। এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে এসো নির্মল পথে।’
সেদিন বিকেলে চাটরা গ্রামে পৌঁছে গেলাম। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষাবিদ রমেশ চন্দ্র গুপ্ত স্মৃতিবিজড়িত চাটরা গ্রাম। গ্রামের নামকরণ হয়েছে চাটাপাতা থেকে চাটরা। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক স্বপন মল্লিক জানান, চাটরা গ্রামের অনেক পুরোনো বাজার মুরালী হাট। এর সঠিক নাম হবে মুরারী হাট। মুরারী মোহন বিশ্বাসের নামে নামকরণ হয়েছে মুরারী হাটের। মুরারী থেকে মুরালী ঘাট নামে পরিচিত। মুরারী মোহন বিশ্বাস ছিলেন বিশিষ্ট সমাজসেবক ও ওষুধ ব্যবসায়ী। তাঁর মুরারী শ্বশুর ছিলেন জনহিতৈষী সারদাচরণ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সারদাচরণ তালুকদার।
অবশ্য মুরালী ঘাটের বর্ষীয়ান মাঝি মো. শফি বলেন ভিন্নকথা। তিনি জানান, মুরালী বাজারকে অনেকে দত্ত বাবুর বাজার বলে থাকেন। অনেকের মুখে মুরালী ঘাটকে দত্ত বাবুর ঘাটও বলতে শুনেছি। ছনহরা গ্রামে দত্ত বাবুর নামে একটি সেতু আছে।
মুরালী সেতুর দুপাশে নৌকা পারাপারের ঘাটলা রয়েছে। প্রকৃতি ডালা সাজিয়ে দক্ষিণে শক্সখনদে নদের মোহনা, উত্তর-পশ্চিমে কর্ণফুলী নদীর বাঁক। লেখক ও গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক বলেন, ‘একসময় বাঁশখালী আনোয়ারার প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন এই খাল দিয়ে পটিয়া আসা-যাওয়া করত। ইন্দ্রপুলে নৌকা-সাম্পানের ঘাট ছিল। আমু মাঝি, তোফাজ্জল মাঝিরা বাঁশখালী থেকেও কাদামিশ্রিত লবণভর্তি নৌকা নিয়ে ইন্দ্রপুলে ভিড়ত। ছোটবেলায় মাত্র দুই আনা দিয়ে কত বেড়িয়েছি; মুরালী ঘাট, নন্দীর ঘাট, বাঁকখালী হয়ে করল টেগরপুনি গ্রামে চলে যেতাম। টেঁয়া পইর-র মেলা দেখার জন্য কী যে নির্মল আনন্দ! কালের বিবর্তনে বদলে গেছে।’
মুরালী ঘাটের দক্ষিণ পাশ দিয়ে আনোয়ারা বাঁশখালী যাওয়া যায়। উত্তর-পশ্চিমে গেলে কর্ণফুলী নদীর মোহনা। ভ্রমণপিয়াসীরা ছোট নৌযানে ক্ষণিক সময়ের জন্য মুরালী ঘাটে এসে নৌভ্রমণ করতে পারেন। নৌকা ভাড়া ঘণ্টাপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা। ছোট ডিঙিনৌকা ও শ্যালুচালিত নৌকা পাওয়া যায়। আমরাও নৌকায় উঠলাম। মাঝি আবুল হোসেন ও শফি মাঝি আমাদের নিয়ে চলল শক্সখনদে নদের মোহনায়। নৌকার চাইতে সাম্পানের ভ্রমণটা বেশ উপভোগ্য। ঘাটে কেঁ কোঁরত কেঁ কোরত দাঁড়টানা মধুর শব্দ, ইঞ্জিনচালিত নৌকার ভটভট শব্দ। শ্যালুচালিত নৌকা শক্সখনদে নদের পানিকে দুই ভাগ করে ছুটে চলে।
সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ে। শেষ বিকেলের চমৎকার দৃশ্য। শক্সখনদে নদের নির্জন পাড়ে কেওয়া বন, দূর থেকে ভেসে আসছিল শেয়ালের ডাক। নৌকার ওপর ছই দিয়ে টানানো হয়েছে ভারী চাদর। নৌকা চলছে দ্রুতগতিতে, দুপাশের জল থই থই। মাঝেমধ্যে বুনো হাঁস, বালিহাঁস, ডাহুকের দেখা মেলে। ডানা মেলে বকের পাল নীড়ে ফিরছে। শস্য মাঠে থেকে গরুর পাল নিয়ে ফিরছে রাখাল বালক। তাই তো রূপপিয়াসী কবি জীবনানন্দের কণ্ঠে শোনা যায়, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’
গোধূলিবেলায় নৌকা মুরালী ঘাটে নোঙর করল। সূর্য তখন লাল আভা ছড়িয়েছে চানখালীর জলের ওপর। ঝিলমিল জলের ঝিলিকে আকাশের বুকে ডুব দিল সূর্য। সাঁজের বেলায় মুরালী ঘাটে প্রকৃতির কী অপরূপা দৃশ্য, নৌকার ছয়ের ভেতর কুপিবাতি জ্বলছে।
বাড়ির কাছে এ যেন এক আরশিনগর, সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মুরালী ঘাট। দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া মুরালী ঘাট হতে পারে আগামীর মিনি পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।
উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা