বাবা, আমি তোমার ‘মা’ হয়ে উঠতে চাই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমার বাবা। মানুষটাকে খুব ভালোবাসি। গরমের তাপ, বৃষ্টির কাদা কিংবা শীতের ঠান্ডা যাকে ছুঁতে পারে না। কখনো যার কাছ থেকে শুনতে হয়নি, ‘তোমার জন্য এটা করতে পারব না, ওটা আনতে পারব না।’ যার কখনো ক্ষুধা লাগে না, পছন্দের খাবার থাকে না। যার জন্য তিনবেলা পেট ভরে খাই, অথচ সেই মানুষটাই দিনের পর দিন দুপুরের খাবার না খেয়ে থাকে।

এই যে এত সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে প্রেমিকের সামনে যাই তার মন রক্ষার্থে, কিন্তু মন না পেয়েও যখন বিচ্ছেদের শোকে কাতরাই, তখন বাবা নামক এই মানুষটাই এসে বলবে, ‘কি রে মা, কী হয়েছে? মন খারাপ? মা বকেছে?’
অথচ এই মানুষটার মনের খবর আমরা কেউ রাখি না। কখনো বলি না,
‘বাবা তোমার মন খারাপ? আজ অফিসে যাওনি, শরীর খারাপ?’

আজ অনেক দিন পর বাড়ি যাচ্ছি, খুব আনন্দ লাগছে। পড়াশোনার জন্য নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় দিনের পর দিন পড়ে থাকতে হয়। মেসে থাকাকালে শুনেছিলাম দাদি অসুস্থ; কিন্তু সেমিস্টার ফাইনালের জন্য আসতে পারিনি।
দেওয়ানগঞ্জ স্টেশন থেকে সোজা নৌকাঘাটে রওনা দিলাম। ওইখান থেকে নৌকায় করে বালাশিঘাট নামব, বাবা সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে বালাশিঘাটের তীর দেখতে পারছি। তীর ঘেঁষে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এই গরমেও ফরমাল পোশাকে দাঁড়িয়ে, নিশ্চয়ই অফিস থেকেই সোজা এখানে এসেছে। দিনের আলো ফুরিয়েছে অনেক আগেই। আবছা আলোয় ঠিকভাবে দেখতে না পারলেও বুঝতে বাকি নেই, মানুষটা বাবা।

আমাকে তড়িঘড়ি করে নামিয়ে সোজা নিয়ে আসে একটা টংদোকানে। দোকানিকে চা দিতে বলে আমার দিকে পানির বোতল বাড়িয়ে বলল, ‘মুখটা ধুয়ে নাও। কী অবস্থা হয়েছে আমার মেয়েটার!’
আমি মুখ ধুয়ে বসলাম সামনের একটা বেঞ্চে। তারপর দুজনে দুই কাপ চা খেয়ে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশে।
আমিই অবশ্য বাবাকে বেশি তাড়া দিচ্ছিলাম। বললাম,
‘বাবা, দাদির জন্য রসমালাই নাও। দাদি খুব মজা করে খাবেন।’
বাবা কোনো কথা বলল না। ভাবলাম, হয়তো শুনতে পায়নি। আমি আবার বললাম,
‘বাবা দাদির জন্য রসমালাই নাও।’
বাবা বলল, ‘বাসায় আছে, তুমি চলো।’

অবশেষে বাসায় পৌঁছালাম। ভেতরে গিয়ে দেখি, অনেকের ভিড়। অবশ্য এটা স্বাভাবিকভাবেই হয়, যখন আমি বাসায় আসি। প্রথমেই দাদির রুমে গেলাম। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে দাদি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। তাই স্বভাবতই বিছানায় চোখ বোলালাম, কিন্তু দাদি নেই। সামনের ইজিচেয়ারটার দিকে তাকালাম, সেখানেও নেই। আম্মুকে জিজ্ঞেস করতে যাব, তখনই ফুফি এসে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলেন। বুঝতে বাকি রইল না, দাদি আর নেই।
আমি কখনোই বাবাকে কান্না করতে দেখিনি। কিন্তু সেদিন দেখেছি। দেখেছি লাল চোখের রহস্য, চোখ ফোলানোর রহস্য। বাবা বোধ হয় এভাবেই কান্না করে চোখ ফোলাত, লাল করত।

যেই মুহূর্ত থেকে তোমার চোখের রহস্য বুঝতে পেরেছি বাবা; সেই মুহূর্ত থেকে সংকল্পবদ্ধ হয়েছি, আমি কখনোই তোমার ভেজা চোখের কারণ হব না। আমি তোমার ‘মা’ হয়ে উঠতে চাই।

বন্ধু, কিশোরগঞ্জ বন্ধুসভা