রাহির প্রথম বর্ষের শেষ পরীক্ষা। ডিসেম্বরের কুয়াশাভেজা সকালে চারপাশে শীতের ঝিমধরা নীরবতা, অথচ রাহির মনের ভেতর এক অজানা গুঞ্জন। পরীক্ষা নিয়ে কোনো ভয় নেই; তার মতো ছেলে কখনোই পাস-ফেলের হিসাব কষে না। তবু মনটা অস্থির। হয়তো সবাইকে মিস করবে বলে, কিংবা অন্য কিছু...
কলেজজীবনের প্রথম বছরটা কেটেছে একটা স্বাধীন সিনেমার মতো। ক্লাস, আড্ডা, শিক্ষকদের রাগ, টিফিনের প্রেমালাপ, পেছনের বেঞ্চের ষড়যন্ত্র—সব মিলিয়ে রঙিন এক অধ্যায়। সে অধ্যায়ের আজ শেষ পৃষ্ঠা।
সুলতানা ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকেই নজর বোলালেন। রাহি, রামিন, চন্দন আর শাকিল চিরচেনা একদল দুরন্ত। চেহারায় খানিক কঠোরতা এনে ম্যাডাম বললেন, ‘তোমরা চারজন আলাদা বসো। আজ পরীক্ষা, কোনো নাটক চাই না।’
চার কোণে ছড়িয়ে গেল তারা। রাহির সিট পড়ল জানালার পাশে, দ্বিতীয় সারিতে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। শুধু বন্ধুরা আলাদা হয়েছে বলে নয়, একটা চাপা দুঃখ অনেক দিন ধরেই জমে ছিল মনে। আজ যেন সেটাই একটু বেশি করে চেপে ধরেছে।
প্রশ্নপত্র হাতে এল। কিছুটা চেনা, কিছুটা অচেনা। যেটুকু মনে ছিল, সেই ভরসায় লিখতে শুরু করল। কলম এগোচ্ছিল ধীরে ধীরে; ঠিক ততটাই ধীরে, যতটা মন হাঁটছিল কষ্টের মধ্যে।
হঠাৎ... চোখ থেমে গেল একটা জায়গায়।
ডান দিকে তিন-চার বেঞ্চ পেছনে বসে আছে একটা মেয়ে। চুপচাপ, স্থির আর ভয়ানক সুন্দর। সেই সৌন্দর্য চোখে। চোখ দুটো কালো কাজলের মতো গভীর, যেন পুরো একটা রাজ্য সেখানে লুকিয়ে আছে। রাহির মনে হলো, এই চোখ যেন কোনো বইয়ের পাতায় দেখেছে, কোনো স্বপ্নে কিংবা কোনো গল্পে। সারা বছর কলেজে তাকে কখনো দেখেনি। তাহলে আজ?
সেই একঝলক যেন সবকিছু উল্টে দিল। অদ্ভুতভাবে মনটা হালকা লাগতে থাকল। পরীক্ষার উত্তরগুলো যেন নিজে থেকেই মনে পড়ে গেল। কলম চলতে লাগল ঠিক যেমন নদী চলে শ্রাবণের জলে। রামিন পেছন থেকে সব লক্ষ করছিল।
রাহি যখনই পেছনে তাকায়, মেয়েটা খানিকটা সরে যায়; যেন তাকে আরও ভালোভাবে দেখা যায়। রাহির খুশিতে মেয়েটি যেন আরও বেশি খুশি হচ্ছিল। পরীক্ষার দুই ঘণ্টায় অন্তত শতবার তাকে দেখেছে সে। একঝলক। একনিশ্বাস।
মেয়েটা যেন উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে! তার চোখের ভাষা, চুলের ঢেউ, ঠোঁটের রেখা সবকিছুই নিখুঁত। বাস্তবে এমন সৌন্দর্য খুব একটা দেখা যায় না।
পরীক্ষা শেষ হলো। মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। রাহি তখনো লিখছে। রামিন বেরিয়ে গেল পেছন পেছন। যেন কাউকে পেছন থেকে না দেখে থাকতে পারছে না।
রাহি ধীরে ধীরে বের হলো। দেখে, রামিন দাঁড়িয়ে আছে গেটের পাশে, মুখে রহস্যময় হাসি। সে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখছিল। মেয়েটা কারও জন্য অপেক্ষা করছিল। কিছুক্ষণ পর আরেকটা মেয়ে এল, সম্ভবত তার বান্ধবী। দুজন একসঙ্গে হাঁটতে লাগল। রামিন দূর থেকে অনুসরণ করতে লাগল। একটু পরে এগিয়ে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করল।
প্রথমে মেয়েরা পাত্তা দিল না। বলার মতো কিছু না। রামিন দেখতে খুব সাধারণ। এমন চেহারায় কেউ প্রেমে পড়ে না। তবে তার উৎসাহ কমল না। রামিন জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বান্ধবীর নামটা কী?’
এমন প্রশ্ন শুনে মেয়েটা একটু বিরক্ত হলো। তবু বলল, ‘ওর নাম তমা’। এইটুকুই।
রামিন দৌড়ে এসে বলল, ‘রাহি! তোর সুন্দরীর নাম তমা।’ রাহি তখনো চুপচাপ। না খুশি, না বিস্মিত। শুধু একটা নাম মাথায় ঘুরতে থাকল। তমা…।
সেদিনের মতো রাহি বাড়িতে ফিরল। মনে হচ্ছিল যেন কোনো স্বপ্ন দেখে ফিরেছে। কিন্তু সেই স্বপ্ন ছুঁয়ে গেছে হৃদয়।
দিনগুলো চলতে থাকল। আরেকটা পরীক্ষার দিন এল। রাহি তমাকে দেখতে পেল না। হয়তো ছিল, খোঁজেনি।
পরীক্ষা শেষে কলেজ গেটের সামনে হঠাৎ আবার চোখে পড়ল তাকে। তমা দাঁড়িয়ে আছে চেনা ভঙ্গিতে। রামিন ইতিমধ্যে কিছু তথ্য জোগাড় করেছে। বলল, ওদের বাসা সাহিত্যনগরের কাছেই। ও আরেকটা বোন, ওরা যমজ!
রাহি থমকে গেল। যমজ! কিন্তু দেখতে তো একেবারেই আলাদা! এ কেমন যমজ?
তমা এখন কলেজজুড়ে আলোচনার বিষয়। অন্য বিভাগের ছেলেরাও তাকে দেখছে, কাছে যাওয়ার ছুতো খুঁজছে। রাহি দূর থেকে চুপচাপ সব দেখে যায়। কিছু বলতে পারে না। তমাকে নিয়ে অন্য কারও কল্পনাও সহ্য করতে পারে না।
কিছুদিনের মধ্যে পরীক্ষা শেষ। কলেজ ছুটি হয়ে গেল। সবকিছু যেন একঘেয়ে হয়ে গেল। তমার দেখা পাওয়াটা রাহির জন্য একরকম থেমে গেল।
(চলবে.. )
আহ্বায়ক, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা