তাপপ্রবাহে মনের যত্ন

তাপপ্রবাহফাইল ছবি : প্রথম আলো
সবার মেজাজ প্রায়ই খিটখিটে থাকছে। ধৈর্য ও সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। রাস্তায় খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে যাঁরা এসি রুমের ভেতর বসে কাজ করছি—সবার অস্থিরতা ভীষণভাবে বেড়ে গেছে।

জলবায়ুর পরিবর্তনে দেশের তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে অতীতের সব রেকর্ড। বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এই গরমে অতিষ্ঠ শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ। শারীরিকভাবে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, একইভাবে ভুগছে মানসিক সমস্যায়।

প্রচণ্ড গরম সবার কাছেই অস্বস্তিকর। এ অবস্থা জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। স্বাভাবিক কাজকর্মে যেমন প্রভাব পড়ছে, তেমনি সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়ছে। আমরাও কেমন জানি ইদানীং একটু বেশি রাগ করছি। যার সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করা সমীচীন নয়, আমরা সে কাজটিই করছি। তাপপ্রবাহ আমাদের চিন্তা ও অনুভূতিকে ভয়ানকভাবে প্রভাবিত করছে। একটুতেই রেগে যাওয়া, বিরক্ত হওয়া, অস্বস্তি অনুভূত হওয়া, অনিদ্রা, চাপ ও ক্লান্ত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। উদ্ভাবনী শক্তি ব্যাহত হচ্ছে।

মনচিকিৎসা শাস্ত্রমতে, অতিরিক্ত তাপমাত্রা শরীরের নিউরোট্রান্সমিটারকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে আমাদের মন, ভালো থাকা ও আনন্দ কমিয়ে দেয়। চাপের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে শরীরে ক্লান্তি লাগে।

আশপাশে খেয়াল করলেই দেখতে পাই, সবার মেজাজ প্রায়ই খিটখিটে থাকছে। ধৈর্য ও সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। রাস্তায় খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে যাঁরা এসি রুমের ভেতর বসে কাজ করছি—সবার অস্থিরতা ভীষণভাবে বেড়ে গেছে। কাজ শেষে বাসায় ফেরার পর বিপত্তি আরও বেশি ঘটছে। সারা দিন গরমের মধ্যে থাকায় একধরনের অস্থিরতা কাজ করে। অফিসে দৈনিক কাজের টার্গেটও অনেক সময় সম্পন্ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেই অকৃতকার্যতা নিয়ে যখন কেউ বাসায় প্রবেশ করেন, তখন তাঁর মধ্যে একধরনের হতাশা, অপ্রাপ্তি ও রাগ কাজ করতে থাকে। হতে পারে বসের কটু কথা শুনে মন খারাপ; একটু রাগও আছে। বাসায় ফিরে সেই রাগ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখাচ্ছি। এতে অজান্তেই মা–বাবা ও স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।

বাসায় যাঁরা থাকছেন, তাঁরাও এই তাপপ্রবাহের বাইরে নন। তাঁরাও আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারছেন না। অনেকের বাসায় ছোট শিশু ও বৃদ্ধ মা–বাবা রয়েছেন। ওনাদের একটা আতঙ্কের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। কখন কী হয়ে যায়! একটু এদিক–সেদিক হলেই হতে পারে হিটস্ট্রোক।

সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ও শ্রমজীবী ব্যক্তি, যেমন রিকশাচালক, কৃষক, নির্মাণশ্রমিক এবং যাঁদের ওজন বেশি, যাঁরা শারীরিকভাবে অসুস্থ, বিশেষ করে যাঁদের হৃদ্‌রোগ বা উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাঁদের শরীরের প্রতি যেভাবে খেয়াল রাখতে হচ্ছে, ঠিক একইভাবে মানসিক দিকটাও দেখতে হচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা এক ভয়ানক আতঙ্কে বাস করছেন।

তাপপ্রবাহে নিজেকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে আমরা যা যা করতে পারি

* প্রথমে আমি চিন্তা করব নিজের যত্ন আমরা কীভাবে নিতে পারি। অতিরিক্ত গরমে কী করলে আমার স্বস্তি অনুভূত হয়। নিজেকে সজীব রাখতে দৈনন্দিন কাজে কী কী ভিন্নতা আনা যায়। এভাবে নিজের যত্ন নেওয়া। একটা পরিকল্পনা করা। আমি কিন্তু জানি আমার কখন কেমন লাগে। সেটা হতে পারে খাওয়ার রুটিন, ঘুমানোর রুটিন, কীভাবে আমরা স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতে পারি।
* তাপপ্রবাহ সম্পর্কে সঠিক জায়গা থেকে তথ্য নেওয়া। এর প্রভাব সম্পর্কে ভালোভাবে জানা। তারপর সে অনুযায়ী নিজের যত্ন নেওয়া।
* দিনে কী পরিমাণ পানি পান করছি, সেটা খেয়াল রাখা। পরিমাণমতো খাচ্ছি কি না, সেদিকেও খেয়াল রাখা। শরীরে যেন কোনোভাবেই ডিহাইড্রেশন না দেখা দেয়।
* যদি অসুস্থ হোন বা কোনো রোগের কারণে নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন; যেমন ডায়াবেটিস রোগী, হৃদ্‌রোগ বা উচ্চ রক্তচাপের রোগী। সে ক্ষেত্রে নিয়মিত ওষুধগুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।
* নিয়মিত গোসল করা। প্রয়োজনে শরীরের কথা চিন্তা করে এক-দুবার গোসল করা যেতে পারে।
* বর্তমানে যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, এ অবস্থা পরিবর্তন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পরিস্থিতি আসলে কারও হাতে নেই। এটাকে গ্রহণ করা। যখন পরিস্থিতিটা গ্রহণ করতে পারব, তখন অস্থিরতা কমে আসবে। আপনি জানেন, কেন আপনার মধ্যে এ ধরনের অনুভূতি হচ্ছে। যখন কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাই, তখনই আমাদের মধ্যে বিপত্তি ঘটে থাকে। আমরা বুঝি, কিন্তু গ্রহণ করতে চাই না।

* এ ধরনের অবস্থায় রাগ, অস্থিরতা, হাঁসফাঁস, অসহ্য লাগা, হতাশা ও অসহায়ত্ব কাজ করবেই। এই পরিস্থিতিতে এ ধরনের অনুভূতিগুলো স্বাভাবিক। প্রায় সবার মধ্যেই হচ্ছে। অনুভূতিগুলোকে এড়িয়ে না গিয়ে গ্রহণ করা।
* গরমের এ সময়ে নিশ্বাসের ব্যায়াম করতে পারি। তাহলে অস্বস্তি অবস্থার একটু পরিবর্তন ঘটতে পারে।
* তারপর একটু সময় নিয়ে হাতে-মুখে পানি দিয়ে স্থির হয়ে বসে রাগের মূল কারণ, অস্থিরতার কারণ, যে চিন্তাগুলো হয়, সেগুলোর কারণ খুঁজে বের করে সমাধান করতে পারি।
* ঘুমের বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দেওয়া। এই গরমে ভারী খাবার রাতে না খাওয়াটাই উত্তম। এমনিতেই গরমের অস্বস্তি এবং খাবার অস্বস্তি—দুইয়ে মিলে আরও অসুস্থ করে দিতে পারে। বিকেলের পর থেকে চা-কফি বাদ দেওয়া। যদি সম্ভব হয় শরবত খাওয়া যেতে পারে। ঘুমানোর আগে গোসল করে নিতে পারেন। হালকা–পাতলা পোশাক পরিধান করে ঘুমাতে যাওয়া।
* এই অবস্থার কবে পরিবর্তন হবে এ চিন্তা মনে আসবে এবং আসাটাও স্বাভাবিক। চিন্তা করলে অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে; বরং পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। তাহলেই কেবল মানসিকভাবে ভালো থাকা সম্ভব।

সবশেষে যদি কেউ নিজে নিজে সমাধান না করতে পারেন, তাহলে পেশাদার সাইকোথেরাপিস্টের সাহায্য নিতে পারেন।

সাইকোথেরাপিস্ট কনসালট্যান্ট, ঢাকা সিটি হাসপাতাল লিমিটেড ও সহসভাপতি, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা