এক.
বিকট বিস্ফোরণে জেগে উঠেছে মানুষ, রাস্তায় হাঁটার সময় কেউ একজন দেয়ালচিত্র দেখিয়ে বলল। পাশে থাকা মানুষটা হঠাৎ যেন নিজেকে ফিরে পায়। অজান্তেই বেরিয়ে পড়া অশ্রু মুছে নেয় পরনের শার্টের হাতায়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে, হ্যাঁ, পেরেছি। আমরাই পেরেছি। আমাদের প্রজন্ম পেরেছে। এমন প্রজন্মের হাতেই তো দেশটা নিরাপদ।
—জানেন, মানুষ সয়ে যেতে যেতে আর পারছিল না।
এই কথা বলে রফিক সাহেব বাবর সাহেবের দিকে তাকিয়ে সমর্থনসূচক সম্মতি প্রত্যাশা করেন। বাবর সাহেবও মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মাথা ওপর–নিচ করে সম্মতি প্রকাশ করেন। সঙ্গে যোগ করেন,
—একেক সময় একেক জেনারেশন একধরনের পরিবর্তনের পথ তৈরি করে দেয়, যা গতানুগতিক হয় না। দেশের অধিকাংশ লোক তাদের ভাষা বুঝতে সক্ষম হয় না। তবে সবাই পরিবর্তন চায়। ইতিবাচক পরিবর্তন।
—আমাদের এই প্রজন্ম যদি ব্যর্থ হয়, দেশটা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না সন্দেহ!
—রফিক সাহেব, এই দেশ বিপ্লবীদের আঁতুড়ঘর। ভুলে গেলে চলবে না। কেউ না কেউ কোনো না কোনো সময় ঠিকঠাক রুখে দেবে দেশবিরোধী যেকোনো চক্রান্ত।
—ইতিহাস তো তা-ই বলে।
রফিক সাহেব ঘড়ি দেখে বাসায় ফেরার রাস্তা দেখিয়ে ইঙ্গিত করেন। দুজনই যে যাঁর যাঁর বাসায় ফিরে যান।
দুই.
প্রতিদিনের মতো ফজরের নামাজের পর হাঁটতে বের হন রফিক সাহেব। হাঁটতে হাঁটতে দেয়ালে আঁকা চিত্র দেখে আর মানে বোঝার চেষ্টা করেন। যদিও বয়সের এই সায়াহ্নে সবকিছু বুঝে উঠতে পারেন না। তারপরও একটি চিত্রে চোখ আটকে যায়। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে দেখেন। এই একই চিত্রই তো বহুকাল ধরে তাঁর চোখের সামনে ঘুরেফিরে আসে। ভেসে বেড়ায় কত আকুতিভরা সেই চিত্র, এবারও নতুন সময়ের চিত্রকর এঁকেছে। চিত্র তো একই, অথচ সময়টা ভিন্ন! যে ছবিটা আমরা সব সময় ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন দেয়ালে দেয়ালে দেখি। একটা লাশ একজন দুই হাতে তুলে চিৎকার কিংবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে দৌড়ে যাচ্ছে। তার সেই আহত ভাইকে বাঁচাতে কী মরিয়া আকুতি! শেষমেশ গুলিবিদ্ধ সেই ছাত্র ভাইকে বাঁচানো যায়নি। আর সেই চিত্র পোস্টার, ব্যানার, দেয়ালে, ক্যালেন্ডারের পাতায় পাতায় আজও অক্ষত! সেই একই চিত্রই যেন ফিরে ফিরে আসে জুলাই বিপ্লবে। গণ–অভ্যুত্থান হয়ে শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শিকল ভাঙার গান হয়ে বাজে।
রফিক সাহেব সেই চিত্রের মিল খুঁজে পেয়ে কাছে গিয়ে ছবিটির গায়ে হাত বুলিয়ে দেন পরম যত্নে। না জানি এই শহীদ বিপ্লবী ছেলেটির চির ক্লান্তির নিদ্রা ভেঙে যায়।
তিন.
উত্তরসূরির কাছে এই সংগ্রাম এবং বিজয় অমর হয়ে থাকবে। রূপকথার গল্পের মতোই মানুষের মুখে মুখে ফিরে। ‘পানি লাগবে পানি?’ ঢাকার রাজপথ অলিগলিই শুধু নয়, মানবপ্লাবন হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোনো এক অত্যাচারী শাসকের সব কুক্ষিগত ক্ষমতা! মুহূর্তেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে, ‘দফা এক দাবি এক’। পৃথিবীটা নতুন করে বাসযোগ্য হয়। আবার আমরা নব উদ্যম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি দেশ গঠনে।
তখনো রফিক সাহেব জানতেন না, তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তান ভার্সিটিপড়ুয়া রায়হানের খোঁজ। এ জন্যই কিনা দেয়ালের সব চিত্র তাঁকে খুব টানে! তখন ঠাহর হয় না যে চিত্রের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের এত এত মিল খুঁজে পেয়েছেন, সেই চিত্রে নতুন ইতিহাস হয়ে ফিরে আসে একমাত্র কলিজার ধন রায়হান।
রাতারাতি চাউর হয় রায়হানের মৃত্যুর খবর। সহপাঠী-বন্ধু সবাই তার লাশ নিয়ে বাড়িতে আসে। বুক পেতে দেওয়া রায়হানের লাশ।
এখন রায়হানের সব বন্ধু রফিক সাহেবকে বাবা ডাকে। আর তিনি নির্বাক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখেন। তাঁরই ঔরসজাত রায়হান হয়তো সালাম, রফিক, বরকত হয়ে ফিরে আসে। আর ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়।
ফুলগাজী, ফেনী