সম্প্রীতির মেলবন্ধনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘নেমক হারাম’

মাজহার সরকারের ‘নেমক হারাম’

বিজয়ের বায়ান্ন বছর উদ্‌যাপন হলো সবে। ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। এই মাসে মুক্তির ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন ঠিক এমনই এক মুক্তির মাসে শীতের সকালে প্রিয় লেখক সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আর এখন মাজহার সরকারের ‘নেমক হারাম’ পড়ে শিহরিত হলাম।

‘নেমক হারাম’ উপন্যাসের শুরুটা হৃৎপিণ্ড আকৃতির বড় একটা পাতা দিয়ে। তারপর গ্রামবাংলার সেই চিরচেনা সৌন্দর্যের বিস্তৃত বর্ণনা, নৌকার বৈঠার শব্দ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝিকে। পরক্ষণে ‘এই সোনাভানই একদিন জুলহাসের বউ হবে। মনে মনে তা পাকাপাকি হয়ে গেছে। নূর আলীরও তাতে দ্বিমত নেই।’ শমসের নামক সহজ–সরল মানুষটির এমন সব ভাবনা নিয়ে গেল গ্রামীণ একটি আবহে। ভেবেছিলাম, হয়তো জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’র মতো আবারও একটি সামাজিক উপন্যাস পড়তে যাচ্ছি আগ্রহভরে। কিন্তু ভুলটা ভাঙে একটু বেলা করে! যখন চড়াই–উতরাই পেরিয়ে জয়গুনকে সঙ্গে নিয়ে শমসেরের পালতোলা নৌকা করে বছর ঘুরে পৌঁছালাম যোগেশ দত্তের বাড়ি।

‘এত লোকসমাগমে কর্তা-গিন্নি উভয়ে ভীষণ খুশি। গিন্নি ছুটে এসে কর্তাকে বললেন, “এমুন চুপ কইরা আছ কিরে? নিরঞ্জনরে বাজারে পাডাইয়া শিগগির পান-বাতাসা আনাও! আমি মুড়ি চিড়া যোগাড় করি।”’ ‘ওই কতা কইয়েন না মিয়া, শমসেররে ট্যাকায় পয়দা করে নাই। আমরার জন্মো ঠিক আছে। যোগেশ দাদুরে ছাড়া আমি কিচ্ছু কইতে পারমু না।’ এভাবে সম্প্রীতির মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা সৌহার্দ্য, সেই সঙ্গে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই উপন্যাসের প্রতিটি লাইন যেন বারবার ইঙ্গিত দিচ্ছিল নাটকীয় কিছুর।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যখন দেশভাগের চূড়ান্ত বার্তা নিয়ে হাজির হলো, সংকীর্ণ কাঠামোর ঊর্ধ্বে গিয়ে যখন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হলো (পরে আওয়ামী লীগ), তখন আর বুঝতে বাকি রইল না ‘নেমক হারাম’ দুটি শব্দের একটি উপন্যাস আমাদের সামনে চূড়ান্তভাবে হাজির হচ্ছে বাঙালি ইতিহাসের বাঁকবদলের প্রতিচ্ছবি নিয়ে। প্রথম প্রজন্মের চরিত্র পেরিয়ে, দ্বিতীয় প্রজন্মের জুলহাস আর সোনাভানের মিথস্ক্রিয়া নিয়ে ‘নেমক হারাম’ এগিয়ে গেল দিগন্তের মধ্যখানে।

১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় যখন শোষকদের বিরুদ্ধে একাত্তরের ৭ মার্চ পূর্ব বাংলার আকাশে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ হয়ে মুক্তির ঝড় তুলল, তখন স্পষ্ট ভেসে উঠল মুক্তিকামী বাঙালির মুক্তির আর্তনাদের সম্পূর্ণ প্রতিচ্ছবি। পাকিস্তানি হায়েনা কর্তৃক নির্মম নির্যাতিত চৌদ্দ বছরের কিশোরী সরলা যেন রূপক হয়ে উঠল আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে সম্ভ্রম হারানো লাখো মা-বোনের। সেই সঙ্গে জুলহাসের সাহসিকতা জানান দেয় অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গভীর দেশপ্রেম। ‘বৃষ্টির মধ্যেই আবার হাঁটতে লাগল জুলহাস-সরলা। কোথাও দাঁড়ানোর এক তিল পরিমাণ জায়গা নেই। ক্যানভাসের অস্থায়ী তাঁবুর ভেতর বৃষ্টি ঝরছে, হাজারো মানুষ ভেজা খড়ের বিছানায় শুয়ে আছে, কেউ ঘুমোচ্ছে।’ ‘নেমক হারাম’–এর এসব লাইন যেন আর্তচিৎকার দিয়ে বর্ণনা করছিল প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া কোটি বাঙালির অবর্ণনীয় কষ্ট।

মায়ের কাছে চিঠি লিখবে বলে পুঁটলি থেকে এক তা কাগজ ও কলম বের করল জুলহাস। ‘প্রিয় মা, তুমি কেমন আছ?’ এই একটা লাইন লিখে কলমটা কাগজের ওপর রেখে ফের মায়ের কথা ভাবতে লাগল। সরলাকে নিয়ে জুলহাস তার মায়ের কাছে ফিরছে, ফিরছে কালনীর উত্তাল ঢেউয়ের কাছে। ‘নেমক হারাম’–এর শেষ লাইন যেন এভাবে হৃদয়ের করুণ আকুতি জানিয়ে সরলা আর জুলহাস হয়ে ফিরে এল বাংলা মায়ের স্বাধীন স্নিগ্ধ আঁচলে। আপাতদৃষ্টে উপন্যাসের শুরুতে মনে হবে ‘নেমক হারাম’ গ্রামীণ উপজীব্যে একটি ভালোবাসার অনবদ্য আখ্যান। কিন্তু উপন্যাসের মধ্যখানে গিয়ে পাঠকের ভুল শুধরে দিয়ে জানান দেবে, এটি গ্রামীণ আবহে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধনে তারুণ্য উপজীব্য মানবিক এক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সহজ-সরল ও সাবলীল ভাষায় রচিত উপন্যাস।