‘খাঁচা’র জয়া যেন ‘পথের পাঁচালী’র সর্বজয়া

‘খাঁচা’ ছবিতে জয়া আহসান, আজাদ আবুল কালামসহ অনেকেছবি: সংগৃহীত

জয়ার মুখে আমি সর্বজয়াকে দেখেছি। আমাদের চিরকালীন গ্রামীণ দরিদ্র গৃহবধূ ‘পথের পাঁচালী’র সর্বজয়া। মুখের মধ্যে যেন বসানো মুখ। হাসি–আনন্দে, দুঃখে, বুকফাটা কান্নায়, বিষাদে বিমর্ষতায়, গানে, সৃজনশীলতায়, সুশীলা, সুলক্ষণা, নিপুণ সংসারী, কর্মকুশলতায়, কখনো জায়া, কখনো মাতা—এ এক ভিন্ন সরোজিনী ‘খাঁচা’ চলচ্চিত্রের জয়া আহসান।

অম্বুজাক্ষের সেতারবাদনের মতো পরতে পরতে হাসান আজিজুল হকের ‘খাঁচা’ কালজয়ী রচনাকে চলচ্চিত্রের ভাষায় বুনতে চেয়েছেন পরিচালক আকরাম খান। গভীর নীরবতা মগজে ধারণ করে মহতী সৃষ্টির রূপনির্মাণের সাধনায় তিনি সফল।
আজিজুল হকের গল্পের মধ্যেই সংলাপ চিত্রায়ন লুকিয়ে থাকে। কথা, চিত্র, দৃশ্য নির্মাণে কিছুটা সুবিধা হয়েছে এমন গল্প বেছে নিয়ে। কিন্তু সেতারের সুর, সেতারের ছেঁড়া তার, ব্যঞ্জনা ধরতে পারাটা ততটা সহজ নয়। তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’ নাটকের মতোই ‘খাঁচা’ গল্পে খাঁচায় জড়ানো মায়া, খাঁচা ছেড়ে যাওয়ায় মুক্তি-বিষাদ, দুর্ভিক্ষ, তার ছিঁড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা লুকিয়ে।

এ যন্ত্রণা দেশবিভাজনের। ব্রিটিশ শাসকেরা আনাড়ি সীমারেখা টেনে দিয়ে চলে গেছেন। অদলবদল করে ওপারের মুসলিমকে মুসলিমের দেশে চলে আসতে হবে, হিন্দুকে বদলে অবস্থান নিতে হবে হিন্দুদের দেশে। মুসলিমের দেশে গেলে যেন মিলে যাবে বেহেশত। হিন্দুদের দেশে আকাশ থেকে দেবতার পুষ্পবৃষ্টির মতো নিয়ত খাবার ঝরে পড়ে! সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা বাংলাকেও কীভাবে চাবুকে চাবুকে ক্ষতবিক্ষত করেছেন ধর্মধ্বজী শাসকেরা।

আর বাস্তবে, মুসলিমের দেশে চলে যাওয়া মুসলিম বাড়িতে করবীগাছ লাগায়। ফুলের জন্য নয়, এই ফুল থেকে অনেক বীজ হবে। অনেক অনেক বীজ। সেই বীজ আসলে বিষ। খাওয়া না জুটলে, বীজ খেয়ে মরে তো যাওয়া যাবে। দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি।
এককালে হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারটির ছবি তোলার দৃশ্য। বনেদি যৌথ পরিবার। হাসিখুশি প্রাণ। নব পরিণয়, দম্পতির খুনসুটি। বৃষ্টি নামলে জল শুষে নেওয়ার কামনা। পরিচালক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

সেই পারিবারিক ছবিও পড়ে ভেঙে যায় একসময়। ফাটল ধরা ভাঙা বাড়িতে সাপ ঢোকে। চিরাচরিত বিশ্বাস ভয় পায় না, সাপকে মারতে দেয় না। উল্টো প্রণাম করে, ঘরে যে তক্ষক এসেছে, মহাভারতের তক্ষক। সাপই আবার সন্তানের প্রাণ কেড়ে নেয়। অম্বুজাক্ষ হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক। কিন্তু কিছুতেই সর্পদংশনের ওষুধের নাম মনে পড়ে না তার। ওঝা আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সন্তান। চিতার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। অম্বুজাক্ষের পিতার পক্ষাঘাত হয়। প্যারালাইসিস, আর কখনো উঠে দাঁড়াতে পারবে না। বৌমার কাছ থেকে আগুন চেয়ে নিয়ে হুঁকায় গড়গড় করে সুখটান দিতে পারবে না।

এত কিছু পেরিয়েও শোক, যন্ত্রণা, ব্যর্থতা, দারিদ্র্য নিয়ে অম্বুজাক্ষের স্বপ্ন, সরোজিনীর স্বপ্ন, একদিন দেশ ছেড়ে যাওয়ার। এমন একটি দেশ, যেখানে কেবল সুখ। আবার নতুন করে সব গড়ে তোলা হবে। সন্তানেরা পড়াশোনা করবে, গান শিখবে।

ভাঙতে ভাঙতে মানুষ শুধু বুঝে উঠতে পারে না, সেই গড়াটা কতটা ভালোবাসায় মোড়ানো হবে। উপায় যে নেই, জন্মভূমি ছেড়ে, জন্মমাটি ছেড়ে যেতেই হবে। এই পরিণতির কাহিনি বুনে তুলেছেন আকরাম খান। কে খাঁচার পাখি, আর কে বাইরের পাখি—এখানে দুজনেরই নির্মম পরিণতি একই। কারণ, রাষ্ট্র চোরা শিকারি দাঁড় করিয়ে রেখেছে পদে পদে। বিষবৃক্ষের চারা নিয়ে মানুষকে শুধু পারাপার করে যেতে হয়।