সন্তানকে মিথ্যাচার থেকে ফিরিয়ে আনতে করণীয়

পরিবারে এমন একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করুন, যেখানে সন্তান সৎ হতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। মডেল: জাকির, তানভীরা ও ঋভুছবি: সুমন ইউসুফ

আপনার, আমার সন্তান অযথা মিথ্যা বলছে। কেন বলছে? এটা কি স্বভাব, নাকি সে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের শিকার? ভেবে দেখেছেন কখনো?

পিতা–মাতারা একটা সময় এসে খেয়াল করি, আমাদের সন্তান কারণে-অকারণে মিথ্যা বলছে। সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা সন্তানটি হঠাৎ করে খুব গুছিয়ে একটা কাল্পনিক কিংবা অসত্য বিষয়কে উপস্থাপন করছে সত্যের মতো করে। হঠাৎ এই পরিবর্তন পিতা–মাতা হিসেবে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?

এই আচরণগত পরিবর্তন বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। পরিবার, সমাজ, পরিবেশ, বন্ধুবান্ধব—এমনকি মানুষের একের প্রতি অপরের আচরণও একজন নিরীহ, সরল, সাদাসিধে সন্তানকে মিথ্যাবাদী করে তোলে। দেখবেন, একটা সময় আপনার সন্তান মিথ্যা বলত না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো একটা বিষয়ে আপনি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে সন্তানের ওপর অযথা দোষারোপ দিলেন, যা সে করেনি। এমন পরিস্থিতির শিকার হওয়া অনেক সন্তান কিন্তু আপনার এই অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য পরে মিথ্যাবাদী হয়ে ওঠে। কখনো কখনো এমন হয়ে যায় যে সে তার জীবনের কোনো ঘটনা আপনার সঙ্গে আর শেয়ার করতে চায় না; এ পরিস্থিতি তাকে আরও ভয়ংকর অপরাধের দিকে ধাবিত করে।

আচরণগত পরিবর্তন কখন হয়
সন্তানের মধ্যে এ ধরনের আচরণ, বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে বেশি প্রকাশ পায়। হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে একটি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়।
বয়ঃসন্ধিকালে থাকা একজন সন্তানের আলাদা মানসিক যত্নের প্রয়োজন হয়, যা আমরা অনেক পিতা–মাতাই জানি না এবং চর্চাও পরিবারে করি না।

সন্তানের আচরণ পরিবর্তন করার জন্য, বিশেষ করে যখন এতে মিথ্যা বলা জড়িত থাকে, তখন আপনার সন্তানকে ধৈর্য এবং সহনশীলতার সঙ্গে যত্ন করুন। বয়ঃসন্ধিকালের সন্তান হলো একটি বেড়ে ওঠা চারাগাছের মতো। দেখে মনে হয় এরা বড় হয়ে গেছে। কিন্তু ব্যাপারটা সে রকম না। তাদের অন্তরে একদিকে শৈশব বা শিশুসুলভ আচরণ, আবার অন্যদিকে বয়ঃসন্ধিকালের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন; যা সেই বয়সে থাকা সন্তানের জন্য অসম্ভব রকমের যন্ত্রণার। এখানে পিতা–মাতা হিসেবে আপনাকে দারুণভাবে সহনশীল হয়ে তার আচরণগত পরিবর্তনগুলো সামলে নিতে হবে।

পিতা–মাতার করণীয়
এ ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ আপনি নিতে পারেন; যেমন সন্তানের সঙ্গে মিথ্যা বলা, এর খারাপ দিক, ধর্মীয় বিধিনিষেধ ইত্যাদি নিয়ে ব্যক্তিগত কথোপকথন করুন। আপনার উদ্বেগ প্রকাশে অসংঘাতমূলক অর্থাৎ সন্তানকে ব্যক্তিগত আক্রমণ থেকে বিরত থাকুন। আপনি নিজেও তাকে অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো বিভিন্ন অযৌক্তিক এবং ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকুন। মনে রাখতে হবে, অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করার কারণে আপনি কিন্তু ধীরে ধীরে তার চোখে অসম্মানের বা অনাস্থার পাত্র হয়ে যাচ্ছেন, যা আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না।

পিতা–মাতারা মনে করি, সন্তানদের সঙ্গে আমরা যেকোনো ধরনের আচরণ করার অধিকার রাখি। তাদের যেকোনো ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমণ করার অধিকার রাখি। এই ভাবনা ঠিক নয়। আপনার সন্তান হলেও সে কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় নিয়ে পৃথিবীতে বড় হচ্ছে। তাই তার আত্মসম্মানের প্রতি সম্মান রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

সন্তানকে মিথ্যাচার থেকে বের করে আনতে মিথ্যা বলার পরিণতি বা এর ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করুন। মিথ্যা বলার পরিণতি ব্যাখ্যা করুন। অন্যদের ওপর এর প্রভাব এবং তার নিজের ওপর সম্ভাব্য বিপদ—উভয় বিষয়ে কথা বলুন। তাকে বোঝান একটি মিথ্যা ঢাকতে প্রয়োজন হয় আরও অনেকগুলো মিথ্যার। এই আচরণ একবার স্থায়ী আচরণে পরিণত হলে তা পরিবর্তন করা কষ্টসাধ্য। তাই এই আচরণকে ছলেবলে এবং কৌশলে অনুৎসাহিত করুন।

পিতা–মাতা হিসেবে নিজেকে সৎ রাখুন এবং সততাকে উৎসাহিত করুন। আপনার নিজের যদি মিথ্যা বলার অভ্যাস থাকে, তাহলে কিন্তু সন্তানকে সত্যবাদী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। সন্তান যদি একবার জেনে যায় বা বুঝে যায় আপনিও মিথ্যা বলেন; তাহলে সে–ও মিথ্যাবাদী হয়ে উঠবে। পরিবারে সততা এবং সততার গুরুত্বকে শক্তিশালী করার দায়িত্ব পিতা–মাতার।

সন্তান সততা প্রদর্শন করলে তার প্রশংসা করুন। ইতিবাচক প্রশংসা সন্তানের আচরণিক পরিবর্তনের জন্য একটি শক্তিশালী প্রেরণা হতে পারে। তার মনে বিশ্বাস তৈরি করুন। তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দক্ষতা নিয়ে কাজ করুন। কঠিন পরিস্থিতি বা দ্বন্দ্বের মোকাবিলা করার বিকল্প উপায় বের করতে সহায়তা করুন।

পরিবারে এমন একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করুন, যেখানে সন্তান সৎ হতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। তাদের সঙ্গে জীবনের প্রতিটি ঘাত-প্রতিঘাত, সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় অনুশাসন ইত্যাদি নিয়ে গল্প করুন। সমাজে প্রচলিত উদাহরণ বা বাস্তব ঘটনা শেয়ার করুন। ভালো দিক, মন্দ দিক বের করুন। পারস্পরিক যোগাযোগকে উৎসাহিত করুন এবং সন্তানকে আশ্বস্ত করুন যে আপনি তার জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে পাশে আছেন।

তারপরও যদি মনে করেন সন্তানের মিথ্যা আচরণ অব্যাহত আছে বা আপনি যদি সন্দেহ করেন যে তার মধ্যে অন্তর্নিহিত কোনো সমস্যা থাকতে পারে; তখন প্রয়োজনে পেশাদার মনোবিদের সঙ্গে কথা বলুন। অথবা সন্তানের প্রিয় কোনো মানুষ, বন্ধু বা আত্মীয়, যার ওপর সে আস্থা রাখে; তার সঙ্গে পরামর্শ করুন। এ ক্ষেত্রে সন্তান যেন এই ব্যাপারটা মোটেই বুঝতে না পারে।

এভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের আচরণের ওপর নজর রাখুন। মনে রাখবেন, আচরণ পরিবর্তন করতে সময় এবং ধৈর্য লাগে। সহানুভূতি ও পরিস্থিতি অনুযায়ী যোগাযোগ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ এবং উপদেষ্টা, রাউজান বন্ধুসভা, চট্টগ্রাম