বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনটা আবিরের কাছে স্বপ্নের মতো ছিল—নতুন বন্ধুরা, ক্লাস, চায়ের আড্ডা। সেই স্বপ্ন মাত্র এক সপ্তাহেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো। রাতে হঠাৎ হোস্টেলের ৪ নম্বর ব্লকের ৩১৮ নম্বর রুমে ডেকে নেওয়া হলো তাকে। দরজা খুলতেই দেখা গেল পাঁচজন সিনিয়র বসে আছে, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
‘আবির, হ্যালো জুনিয়র! র্যাগিং বলতে কিছু শুনেছ?’
আবির জড়সড় হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ ভাই, কিন্তু আমি তো—’
‘চুপ! এখন থেকে আমরা যা বলব, অন্ধের মতো পালন করবি।’
প্রথমে হালকা কথা, গান গাওয়া, আইটেম গানে নাচ, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ঝাড়ুকে প্রপোজ করা। আবির লজ্জা পেলেও মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে শুরু হয় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের আসল পর্ব।
সিনিয়রদের মধ্য থেকে মোটাসোটা একজন, যার কপালে কাটা দাগ। নিজের পায়ে পরা ছেঁড়া ভেজা জুতা মনে হচ্ছে মাত্র বাথরুম থেকে এটা পরে বের হয়েছে; ওটা খুলে মুখের সামনে এনে বলল, ‘এটা চাটবি। ভালো করে চাটলে বেঁচে যাবি। না হলে... মাথা ন্যাড়া করব, আর কী করব, ভাবতেও পারবি নারে।’
আবির থমকে যায়। মুখে কাঁপুনি। তবু চেপে ধরে নিজের সম্মান আর ভয়, তারপর জুতাটা ঠোঁটে নেয়। সবাই হো হো করে হাসে, মোবাইল বের করে ভিডিও করে। পুরোনো, দুর্গন্ধযুক্ত ছেঁড়া ভেজা জুতা দিয়ে মালা বানিয়ে তা গলায় পরিয়ে দেয়। আবির বাধা দিলে তার গালে কষিয়ে থাপ্পড় মারে একজন। ‘তুই কি নিজেকে অনেক কাবিল ভাবিস? বিশ্ববিদ্যালয় মানে যা বলি শুনবি!’
জুতার মালা পরানোর পর আবিরকে বলা হয়, ‘সব খুলে ফেল। একটাও কাপড় থাকবে না।’
সে ভয়ে থরথর করে কাঁপে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ভাই, প্লিজ...আমার মা আমাকে এমন অবস্থায় দেখলেও লজ্জায় মরে যেতেন।’
তারা হাসে। কেউ বলে, ‘এখানে মা নেই, আছি শুধু আমরা। আর এখন থেকে তুই কে, সেটা আমরা ঠিক করব।’
হাত ধরে জোর করে জামা ছিঁড়ে ফেলে একজন। আরেকজন জোর করে প্যান্ট খুলে নেয়। আবির বাধা দিতে চায়, কিন্তু পাঁচজনের শক্তির সামনে সে একা। তার মনে হয় যেন প্রতিটি ছোঁয়াই একেকটা অপমানের ছুরি। নিজেকে ঢাকতে গিয়ে সে মাটিতে বসে পড়ে, দুই হাত দিয়ে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করে। কিন্তু ওদের একটাই কথা— ‘এটাই নবীনবরণ। যদি মুখ খুলিস, এই ভিডিও ফেসবুকে যাবে।’ আবির মাথা নিচু করে কাঁদে। বিবস্ত্র শরীর, গলায় ঝুলছে একটা ছেঁড়া জুতা!
সেই রাতেই হোস্টেলে ফিরে আসে আবির, নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। ঘুম আসে না, খাওয়া হয় না, শুধু কাঁদে। সারা শরীর কাঁপে, মাথায় ঘুরতে থাকে সেই অপমান, সেই ছবি, সেই হাসি। কিন্তু আবির মরে না, আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় এলেও তা ঝেড়ে ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি বাতিল করে ঢাকার ফার্মগেটে একটি মেস ভাড়া নেয়। ছয় মাসের চেষ্টায় পেয়ে যায় স্কলারশিপ। ভর্তি হয় লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা