রেনু

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বসে বসে রান্নার জন্য শাপলা কাটছে রেনুর মা। পাশে বসে ফুলগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে পিচ্চি রেনু। বয়স ৫ বছর। বাঁ হাত দিয়ে আরেকবার মাকে নাড়া দেয়। ‘মা এই ফুল দুইডা আমি নেই? খোঁপা বানাইমু।’ এ নিয়ে তিনবার বলল। রাগে চোখ বড় করে তাকায় মা। ভয় পেয়ে চুপচাপ উঠে চলে যায় রেনু।

সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। সূর্য ওঠেনি। চারদিকের গাছপালাগুলো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আচমকা দমকা হাওয়া শুরু হয়। গাছপালা নুইয়ে দিচ্ছে বারবার। জোয়ারের পানিতে চারপাশ টইটম্বুর। কলাগাছের ভেলা ছাড়া বাড়ি থেকে বের হওয়া যায় না।

কোনো কাজেই মন বসছে না রেনুর মার। দুরু দুরু মন নিয়ে একবার এটা গোছায়, আরেকবার ওটা। গত বছরও ঠিক এই দিনে বন্যা হয়েছিল।

শাপলা কাটা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় রেনুর মা। ঘরে চাল নেই। তেলের বোতলটাও প্রায় খালি। রসুইঘরের কাছটায় বসে পুতুলের সঙ্গে বিড়বিড় করছে রেনু। আশপাশে কোথাও ভেলাটা নেই। বিলের মাঝখান থেকে শাপলা তুলে এনেছিল মাজেদ। এরপর সে কোথায় নিয়ে গেছে, কে জানে। বারকয়েক নাম ধরে হাঁক দেয় রেনুর মা। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ঘরের ভেতর চলে আসে। সকালে ঘর ঝাড়ু দেওয়ার সময় চৌকির নিচে কয়েকটা ছোট গর্ত দেখেছিল। এমনিতেই বর্ষার দিন। চারদিকে থই থই করছে পানি। সাপখোপ এসে লুকিয়ে থাকতে পারে এসব গর্তে। কাঁচি হাতে নিয়েছে সেগুলো বন্ধ করার জন্য। রেনুর মা স্পষ্টই শুনতে পায়, আহ্লাদিত কণ্ঠে রেনু ছড়া কাটছে। ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই। ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামা বাড়ি যাই।’

মেয়েটার জন্য ভীষণ মায়া হয় মায়ের। এই তো ৫ বছর পূর্ণ হলো। কেমন চুপচাপ শান্তশিষ্ট। বুদ্ধিমানের মতো একবার বললেই বুঝে যায়। কোনো জুটঝঞ্ঝাট নেই। উগ্র মেজাজের হলে এই অভাবের সংসারে উপায় ছিল না। কাছে গিয়ে আদর করতে ইচ্ছে হয় তার। নাহ থাক, এখন ও নিজের মতোই খেলুক। আপন কাজে মন দেয় রেনুর মা। একটু পর ভেলা নিয়ে আসে মাজেদ। তার সমস্ত শরীর ভেজা। চোখেমুখে আতঙ্ক। দূর থেকে মা মা বলে চিৎকার করতে থাকে। ডাকের আওয়াজ শুনে ঘরের বাইরে আসে রেনুর মা। মাজেদ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলতে থাকে, ‘মা! শুনলাম আইজ রাইতে নাকি বন্যা শুরু হইব। সবাই মাতবর বাড়ি সাইক্লোন শেল্টারে যাইতাছে।’

কিছুটা ভয় পায় রেনুর মা। এখন তো বর্ষাকাল। বন্যা হওয়ার উপযুক্ত সময়। আবহাওয়ার অবস্থাও খুব একটা ভালো না। বিচলিত হয়ে যান তিনি। ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রেনুর মা জিজ্ঞেস করে, ‘তোর বাপ কই গেছে?’ জোর কণ্ঠে মাজেদ উত্তর দেয়, ‘বাজান কই জানি গেছে। আর আপনেরে বলছে সব গুছাইতে।’

কোনো কাজেই মন বসছে না রেনুর মার। দুরু দুরু মন নিয়ে একবার এটা গোছায়, আরেকবার ওটা। গত বছরও ঠিক এই দিনে বন্যা হয়েছিল। কোনোমতে ঘরটা ঠিক ছিল। রান্নাঘরটা পড়ে গেছে। পাশের বাড়ির কলিমউদ্দির ঘরটাও পড়ে গেছে বাতাসে। ঘরের নিচে পড়ে মারা গেছে ছোট ছেলেটা। এসব ভাবতেই আঁতকে ওঠে রেনুর মা। হঠাৎ তার স্মরণ হয় ছোট রেনুর কথা। রসুইঘরের কাছটাতে রেনু নেই। ভেলাটা এখানেই পড়ে আছে। মাজেদ ভেজা কাপড় বদলাচ্ছে। ঘরের এপাশ-ওপাশ খুঁজতে থাকে। রেনু নেই। বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। বারকয়েক চিৎকার দেয় রেনু রেনু বলে। নাহ কোনো সাড়াশব্দ নেই। চারদিকেই তো পানি। তা ছাড়া একটু আগেই এখানে বসেছিল। এরই মধ্যে কোথায় গেল? পানিতে পড়ল না তো!

রেনুর মা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেয়। মাকে সান্ত্বনা দিতে ছুটে আসে বালক মাজেদ। রেনুর মার কান্না শুনে আশপাশের লোকজনও দৌড়ে আসে। সবাই মিলে অনুসন্ধান করে। নাহ, কোথাও কোনো খবর নেই। কে একজন যেন বলল, রসুইঘরের পাশের ডোবাতে নেমে খুঁজলে কেমন হয়৷ কয়েকজন নেমে পড়ে তৎক্ষণাৎ। কিছুক্ষণ অনুসন্ধান করতেই পাওয়া যায় রেনুর লাশ। তার হাতের মধ্যে প্লাস্টিকের খেলনা পুতুল।