বিয়েবাড়িতে গেলে অনেকেই প্রেমে পড়ে। এর একটা কারণ হতে পারে, একজনের বিয়ে মানে দুটি মনের, দুই জোড়া হাতের সারা জীবনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মিলন হচ্ছে। আর সেখানে সঙ্গী না থাকা ব্যক্তিটির মনের মধ্যে শূন্যতা আরও বেড়ে যায়। ঠিক এ রকম—আমার মিলন হবে কত দিনে? দ্বিতীয়ত, বিয়েবাড়িতে একই সঙ্গে পরিবার–পরিজন, বন্ধুবান্ধব, বন্ধুর বন্ধু, আত্মীয়ের আত্মীয়সহ অনেক মানুষের সমাগম ঘটে। সবাই খুব সেজেগুজে আসে। ফলে প্রথম দেখাতে কেউ কারও প্রেমে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বুকের মধ্যে সানাই বেজে ওঠে। কিছুটা পূর্বপরিচিত বা সম্পূর্ণ অপরিচিত ফুলের মতো দুটি মন পরস্পরের কাছে আসে। ধীরে ধীরে প্রেম হয়। রাফি আর অনার তেমনই একটি মিষ্টি প্রেমের কাহিনি আমাদের সামনে হাজির করেছেন তরুণ নির্মাতা প্রবীর রায় চৌধুরী। ‘লাভ সাব’ নামের এই ফিকশনের চিত্রনাট্য লিখেছেন প্রবীর রায় চৌধুরী ও অনীক ইসলাম।
যাত্রাটা শুরু হয় ট্রেনে। শেষ দৃশ্যের মিলনটিও হয় স্টেশনে। জীবনের অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়ে ট্রেন থেকে নেমে বিরহ কাতর প্রেমিক তার মিলন কামনায় দগ্ধ প্রেমিকাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
শুরুতে রাফি, রবিন, আকাশ, নীলয় চার বন্ধু অর্কের বিয়েতে যাচ্ছে। একই কামরায় ওঠে একই বিয়েবাড়ির অন্য যাত্রী অনা। সঙ্গে তার হবু স্বামী জয় এবং আরও দুজন বন্ধু। হবু স্বামী মানে এখনো অনা সিদ্ধান্ত নেয়নি। তিন মাস দুজনে মেলামেশার পর সিদ্ধান্ত নেবে। জয় আর অনার বাবা দুজন বন্ধু। তাদের ইচ্ছা দুই সন্তানের মিলন হোক। কিন্তু আজকের ছেলেমেয়েরা অনেকটা স্বাধীন। মিলেমিশে কিছুদিন সময় কাটানোর মধ্যে সিদ্ধান্ত পর্ব তুলে রাখতে পারে। জয়ের স্বভাব অনেকটা বডিগার্ডের মতো। সবকিছুতেই ওভার কেয়ারিং, অনার ওপর দখলদারত্ব। অনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। অনার এসব ভালো লাগে না। আজকালকার ছেলেমেয়েরা এভাবেই আধিপত্য–শাসনের জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। পরিচালক শৃঙ্খলহীন সেই স্বাধীন মানসিকতাকে কুর্নিশ করছেন।
এই মিষ্টি প্রেমের গল্পের বুননে ‘দেখা’ শব্দটি বিশেষ প্রাধান্য পেয়ে নানা রূপে নানা ভাবে বারবারে ফিরে এসেছে। অর্ক যেমন রিয়ার চোখে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। ভবিষ্যতের বাচ্চাকাচ্চা থেকে নারীর কাঁধে ঝোলানো চিরন্তন চাবির গোছার মতো বিষয়–সম্পত্তি, প্রতিপত্তি সবকিছু দেখতে পায়। সময় পেলেই সে শুধু রিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে মুহূর্তকে উপভোগ করে। রিয়া বলে, ‘সারা দিন তাকায়ে থাকো, কোন সুখে?’ অর্ক উত্তর দেয়, ‘সুখে না, অসুখে। তোমারে দেখার অসুখে।’ ভালোবাসাও তীব্র অসুখ আক্ষরিক বাণীর মতো উঠে আসে।
রায়হান রাফির ‘টান’ চলচ্চিত্র নিয়ে লেখার সময় উল্লেখ করেছিলাম, একালের সময়ের বিষয়বস্তুকে সামনে রেখে আজকের পরিচালকেরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। একালের মনের ভাষায় চলচ্চিত্রে সুর আর কথার বাঁধুনিতে গান থাকছে। এখানে কবিতাও নিয়ে আসা যায়। অসামান্য কবিতার চিত্রায়ণে প্রবীর সেই জায়গাটাও পূর্ণ করে দেখালেন। এর মধ্যে ‘আমার থাকা না থাকাতে তোমার কিছু যায় আসে না যেমন আজ/ আমিও যদি তেমন হই নিতে পারবে?’ কবিতাটি অসাধারণ লাগে।
গীতিকার ইসতিয়াক আহমেদের লেখা জাহিদ নীরবের সুর করা ইমরান মাহমুদের কণ্ঠে ‘তোমার প্রেমে পড়তে চাই...’ গানটি ভালো লাগে। যেমন কথা, তেমন সুর, চিত্রায়ণ অনবদ্য। গানের সঙ্গে তুমুল নাচে আকাশ সেন আর পর্শীর কণ্ঠে গীতিকার সালাউদ্দিন সাগরের লেখা এফ এ প্রীতমের সুর করা ‘প্রেমের ঝাঁজে’ গানটিও জমজমাট।
রাফি আর অনার চরিত্রে তৌসিফ মাহবুব ও তানজিম সাইয়ারা তটিনী মুগ্ধ করেছেন। তটিনীর চোখের দেখার মধ্যে বাস্তবেই অনেক কবিতা লুকিয়ে আছে। যেমন লুকিয়ে আছে তৌসিফের চোখের ইশারায়। দুজনই আগামীদিনে আরও অনেক অনেক দূর যাবেন। আরও অভিনয় করেছেন কিংকর আহসান, জীবন রায়, ইরা, সফিউল আজম বাবু, নাবিলা আলম পোলিন, মাসুম রেজয়ান, মুন্না আহসান, মুহিত তমাল, স্নেহা বাউল, বন্ধন মিত্র, পুলক অনিল।
সুমন হোসাইনের ক্যামেরার ভাষা, আরিফিন সরকারের সম্পাদনা ও রং বিন্যাস প্রাণবন্ত। আবহসংগীত দিয়েছেন আপেল মাহমুদ এমিল। যন্ত্রসংগীতে ছিলেন আরও অনেকে। বিয়েবাড়ি যাঁরা সাজিয়ে তুলেছেন তাঁদের কৃতিত্বও কম নয়। একটি সফল নির্মাণ অনেকেরই শিল্পীসত্তা ও শ্রমের ফসল। এ রকম একটা বিয়েবাড়ির প্রেম নিয়ে বড় একটা চলচ্চিত্র হতে পারে। প্রবীর রায় চৌধুরী এগিয়ে চলুন।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত