স্বাধীনতার ৫০ বছর আসলে কী? ৫০ বছরের অর্থ আমি যা বুঝি, আমার নাতনি তা বোঝে না। আমার কাছে ৫০ বছর মানে একটা আবেগ, পাকিস্তান ভেঙে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা পেয়েছি, সেই আবেগ। আমার নাতনি আর তার বন্ধু গলা ধরে নিশ্চিন্তে হাঁটছে, সেটা তার কাছে স্বাধীনতার মানে।
৫০ বছর ধরে আমরা একটা রাস্তা তৈরি করেছি। আমাদের নতুন প্রজন্ম যখন সেই রাস্তা দিয়ে যাবে, তখন কোনো কটু কথা শুনতে হবে না, সাহসের সঙ্গে যেতে পারবে; তখনই আমাদের স্বাধীনতার স্বাদটাকে উপভোগ করতে পারব। আমি যদি বলি, এই ৫০ বছরে ঠিক এ রকম একটা রাস্তা আমরা তৈরি করে দিতে পেরেছি, তাহলে সত্যটাকে অগ্রাহ্য করা হবে। আমাদের সময় মাথার ওপর বিশাল এক আকাশ ছিল। দিনের বেশির ভাগ সময় আমরা সেই আকাশের নিচেই থাকতাম, ঘরে থাকতাম কম। যা ইচ্ছা করো, যেখানে ইচ্ছা যাও। ‘ওমুক গাছে পাখিরা বাসা করেছে, চল দেখে আসি’—এই বলে কেউ ডাক দিলে, আমরা ছুটে চলে যেতাম। আমার পরের প্রজন্ম সেই আকাশ কিছুটা পেলেও এর পরের প্রজন্মের মাথার ওপর আকাশ দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে গেছে। এখন আমরা পাখির বাসা দেখার জন্য বনে যাই না, মুঠোফোনে দেখি।
বন্ধুর সঙ্গে সরাসরি দেখা করার, কথা বলার যে আনন্দ, সেটা ভুলে গেছি। তাদের সঙ্গে কোথাও বসে আড্ডা দেওয়ার ভেতরে যে কী পরিমাণ উচ্ছ্বাস লুকিয়ে থাকে, সেটা এই প্রজন্ম চোখেই দেখেনি। আমাদের মাথায় এখন ঢুকে গেছে রাতারাতি আমাকে কোটিপতি হতে হবে। আমরা ইতিহাস ভুলে বসে থাকি। আতিথেয়তার ধার ধারি না। বিনয়ের কাছেও ঘেঁষি না। আর এতেই ঘটে পারিবারিক অবক্ষয়। পরিবার কলুষিত হতে হতে সমাজের অবক্ষয় বয়ে নিয়ে আসে।
এখনকার শিশুদের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, তার খালাতো বা মামাতো ভাইবোনদের নাম কিংবা তারা কে কী করে? হাতে গোনা কয়েকজনকে পাব, যারা সবকিছুর উত্তর ঠিকঠাক দিতে পারবে। বেশির ভাগ জানেই না তাদের মামারা-খালারা কে কোথায় থাকেন। যে মামার একটু পয়সা আছে, তাঁকে চিনে রাখে সবাই, বাকিদের খোঁজই থাকে না সারা বছর। আমাদের সময় মায়ের ভাইয়ের সংখ্যা হতো ৫ কিংবা ১০ জনে। মামাতো ভাইবোন আরও বেশি। সেসব ভাইবোনের নাম-ধাম তো এমনিই মনে থেকে যেত, তাদের পছন্দ-অপছন্দ, পড়াশোনা—সবকিছুই ছিল আমাদের নখদর্পণে।
পারিবারিক এই বাঁধন আলগা হতে শুরু করেছে। শুরু করেছে বলাটাও এখন খাটে না, আলগা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এই আলগা হওয়াটাই স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আমাদের বড় দুর্বলতা। ৫০ বছর টিকে গেছি, এটা ভেবে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে বসে থাকলে সামনে আমাদের কঠিন দিনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
আমাদের সামাজিকতায় কিছু প্রথাগত ভুল আছে, যেগুলো শুধরে নেওয়া উচিত। শিক্ষকেরা ছাত্রদের শেখাচ্ছেন লাল বাতি জ্বলা মানে গাড়ি থেমে যাবে, আর সবুজ বাতি মানে গাড়ি চলবে। অথচ সেই ছাত্রই যখন বাসে বা সিএনজিতে করে মা-বাবার সঙ্গে বের হয়, তখন দেখে পুলিশ হাত নাড়ালে গাড়ি চলে, আবার হাত নাড়ালে গাড়ি থেমে যায়। হয় রাষ্ট্রযন্ত্রকে বাতি বন্ধ করতে হবে, না হলে ট্রাফিক পুলিশ। তবে এটা নিয়ে কোনো চেঁচামেচি নেই, কোনো হা-হুতাশ নেই। চেঁচামেচি তখন হয়, যখন আমার বাবার চেয়ে আমার চাচার বেশি টাকা হয়ে যায়। আমাদের নতুন প্রজন্ম এটা চিন্তা করতে বসে পড়ে আর হিসাব মেলাতে থাকে। অন্যদিকে পড়াশোনা যায় গোল্লায়। পড়াশোনা ঠিকভাবে না করলে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যেতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। তখন দোষ হয় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের গাফিলতি অবশ্যই আছে; এখনো ঘুষ বা দুর্নীতির নগ্ন সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। তারপরও আগে আমাদের জ্ঞানের পরিধিটা বাড়ানো উচিত। শিক্ষালাভের সময়টা সঠিকভাবে ব্যয় করা উচিত।
৫০ বছর পূর্তি অনেক বড় অর্জন। তবে এই অর্জনের সঙ্গে আমাদের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দুর্নীতি—সব দিকেই অর্জন যদি সমানতালে এগোতে পারত, তবে এই পূর্তি আমাদের জন্য সুখকর হতো। এই দেশ হাজার বছর বেঁচে থাকবে, যখন প্রতিটি প্রজন্ম বেঁচে থাকার মতো বাঁচার অধিকার পাবে। পারবে খোলা আকাশের নিচে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে। নিজেদের খাপছাড়া ভাবনাগুলোকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে।
শামসুর রাহমানের ‘গেরিলা’ কবিতার মতো, ‘তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছ হাত ধরে পরস্পর।’ স্বাধীনতার বয়স বাড়বে, প্রজন্ম সুগঠিত হবে। তবে দুটোকেই চলতে হবে হাত ধরে সমানতালে। শুধু গা বাঁচিয়ে চলার মতো সময় আমাদের এখন আর নেই। আমার কাছে মনে হয়, আমি যেদিন চোখ বন্ধ করব, সেদিন যেন অন্তত শান্তিতে চোখ বন্ধ করতে পারি। যেদিন আমার নাতি-নাতনিরা আমাকে ছাড়পত্র দিতে পারবে, আমি এখন যেতে পারি, তখনই বুঝব আমার দায়িত্ব আমি সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছি।
শ্রুতলিখন: আল সানি
প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘তারুণ্য’, নবম সংখ্যা, মে ২০২১ থেকে নেওয়া।